Advertisement
০৫ মে ২০২৪

চুপিচুপি জেগে উঠছে রায়মাটাং

সবুজ পাহাড় আর জঙ্গলের হাতছানি উপেক্ষা করি, এমন বুকের পাটা আমার নেই।

জয়ন্তী

জয়ন্তী

তপনকুমার ভট্টাচার্য
চৌধুরীপাড়া, কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৫৯
Share: Save:

সবুজ পাহাড় আর জঙ্গলের হাতছানি উপেক্ষা করি, এমন বুকের পাটা আমার নেই।

তাই পুজোর ছুটিতে উত্তরবঙ্গে যাবার প্রস্তাবটা পেতেই, এক বাক্যে ‘হ্যাঁ’ বলে দিয়েছিলাম। দেবাশিসদা আর রমেনদার সঙ্গে আমিও চেপে বসলাম তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেসে। ভোর রাতে যখন একে একে তিস্তা, তোর্সা, রায়ডাক, জলঢাকা নদীগুলো পার হচ্ছি, তখন থেকেই রোমাঞ্চের শুরু। ওই রোমাঞ্চ শব্দটাই কি ইংরেজিতে রোমান্স? হবে হয়তো।

সূর্য উঠলে দূরে নীল মেঘের বুকে শ্বেতশুভ্র ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’কে উঁকি মারতে দেখে মন ভাল-করা বাতাস বয়ে গেল। আপন মনেই বলে উঠি, ‘‘ওই তো কাঞ্চনজঙ্ঘা!’’ অন্যদের নজরও তখন জানলায়।

যথাসময়ে নিউ আলিপুরদুয়ারে নেমে আমরা গাড়ি করে পৌঁছে গেলাম হোটেলে। একে একে স্নান-খাওয়া সেরে তার পর গাড়িতে সোজা ‘রসিকবিল’। ১৭৫ হেক্টর জলাভূমি ঘিরে শাল, সেগুন, শিশু, অর্জুন, শিমুলের দল এই অরণ্যে রাজ করছে। এই বিল ও জঙ্গল অতীতে ছিল কোচ রাজাদের মৃগয়াভূমি। এখনও এখানে জলে কুমির (মেছোকুমির), আর ডাঙায় বাঘ। বাঘ অবশ্য ছাড়া আছে জাল-ঘেরা নির্দিষ্ট এলাকায়। কোথাও ময়াল সাপ, কোথাও হরিণ, আবার কোথাও ময়ূর। বুঝতে অসুবিধা হয় না— ‘বন্যেরা বনে সুন্দর...’ হলেও এ ভাবে ঘেরা না থাকলে ওদের দর্শন পাওয়া সম্ভব নয়। যদি বা দর্শন মেলে তবে তার পরিণতি সম্পর্কে সন্দেহ থেকেই যায়।

বিলের ওপর দিয়ে ঝুলন্ত ব্রিজ পার হয়ে যেতে হল হরিণ জঙ্গলে। বিলে নৌকাবিহারের ব্যবস্থাও আছে। শীতে এখানেই আসবে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি। এখন ঠান্ডা নেই, তাই পাখি দেখার আশা ত্যাগ করতেই হল।

এখান থেকে বেরিয়ে গাড়ি চলল কোচবিহার রাজবাড়ির উদ্দেশে। রোমের সেন্ট পিটার্সের অনুকরণে ইতালীয় শৈলীতে গড়া এই প্রাসাদটি সত্যিই চমৎকার। দ্বিতল প্রাসাদের মাঝখানে বিশাল গম্বুজ, দু’পাশে বিস্তৃত কক্ষ, সামনে বিশাল ঘাসের লন ও ফুলবাগান। পাশেই সুবিশাল দিঘি। এখানকার মিউজিয়ামটিও দেখার মতো। সেই সময়ের পোশাক, ব্যবহৃত জিনিসপত্র, অস্ত্রশস্ত্র, বাদ্যযন্ত্র, এমনকী বিলিয়ার্ড বোর্ডটিও ভ্রমণার্থীদের আকর্ষণ করে।

কী করে যাবেন?

হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে আলিপুরদুয়ারগামী যে কোনও ট্রেন।

কখন যাবেন?

বর্ষা ছাড়া যে কোনও সময় যাওয়া যায়। তবে সব থেকে ভাল শীতকাল।

কোথায় থাকবেন?

থাকা-খাওয়ার অনেক হোটেল নিউ আলিপুরদুয়ারে।
কোচবিহারেও থাকা যায়। এ ছাড়াও রসিক বিল, রাজাভাতখাওয়া,
জয়ন্তী—সর্বত্রই থাকা-খাওয়ার ভাল ব্যবস্থা আছে।

ফেরার পথে দেখলাম বাণেশ্বর শিবমন্দির। মন্দিরের পাশে একটি বড় জলাশয়। সফ্ট শেল টরটয়েজ (নরম আবরণী যুক্ত কচ্ছপ) সংরক্ষণ করা হয় সেখানে। আমেরিকা ও অস্ট্রিয়ার যৌথ সহযোগিতায় এই উদ্যোগ। পাশেই বোর্ডে বড় বড় হরফে লেখা— ‘‘কচ্ছপের গায়ে হাত দেওয়া বা ধরা বারণ।’’

পরের দিন সকালে আমরা রওনা হলাম জঙ্গল-ঘেরা সৌন্দর্যের রানি ‘জয়ন্তী’র দিকে। সত্যি, মুগ্ধ হয়ে গেলাম জয়ন্তীর রূপ দেখে। এই অক্টোবরে ‘জয়ন্তী’ নদীর শান্ত, স্নিগ্ধ, নীল জলধারার এক রূপ, আবার বর্ষায় তার দু’কূল ভাসানো রূপ— কল্পনা করাই যায় নদীপারের নুড়ি, পাথর ও বালির বিস্তার দেখে। ও-পারে নীলচে সবুজ পাহাড় আর তার খাঁজে আটকে আছে স্তূপাকার সাদা মেঘ। গাড়িতে এসে আচ্ছন্নের মতো বসলাম। এমন মনোমুগ্ধকর ছবি যিনি আঁকলেন, সেই শিল্পীর কথা ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম ‘রায়মাটাং’।

রায়মাটাং মানেই জঙ্গল আর চা-বাগান। দিগন্তবিস্তৃত সবুজের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি এক আশ্চর্য মানুষের খোঁজে। লোকে তাঁকে বলে ‘গাছবাবা’। ঘরবাড়ি ছেড়ে গত ২১ বছর ধরে তিনি বাস করেন গাছের কোটরে। আমরা তো সেই কবে অরণ্যগুহা ছেড়ে বেছে নিয়েছি ইট-লোহা-সিমেন্টের ‘জঙ্গল’।

একে-তাকে জিজ্ঞাসা করতে করতে কালচিনি ব্লকের জঙ্গলের মধ্যে দেখা পেলাম তাঁর। দু’টি গাছ—পিপুল ও ময়না পাশাপাশি প্রায় জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। তারই কোটর থেকে বেরিয়ে এল বারমুডা ও টি-শার্ট পরা মাঝবয়সি গাছবাবা। মুখে হাসি। ভাষা হিন্দি, ফলে ঝরঝরে বাংলা জানেন না। ভাঙা ভাঙা বাংলায় আলাপ-পরিচয় সারলেন।

রসিকবিল

গাছের কোটরে চোখ পড়তেই নজর গেল গাছ-বাবার সংসারে। একটা ড্রয়িং শিটে কালি দিয়ে ছবি এঁকে ও কিছু লিখে টাঙিয়ে রেখেছেন তিনি। কোটরের ভিতরেই দোতলা-তিনতলা শোয়া-বসার জায়গা গাছের ডাল-বাঁশ-কাঠ দিয়ে বানানো। পাতা রয়েছে বিছানাও।

বললাম, ‘‘বাড়িতে থাকো না কেন?’’ ও বলল, ‘‘এই তো বাড়ি। সবাই আমার আত্মীয়। আবার কেউ কারও নয়। এখানে রাতে পাল পাল হাতি আসে। ওরাও আমার আত্মীয়। ক্ষতি তো করে না।’’

—‘‘আর খাওয়াদাওয়া?’’

—‘‘ওই তো উনুন। জুটলে খাই, না হলে না।’’

ওর আঁকা ছবিতে দেখি একটা বিচ্ছিন্ন পাখি, আর তার ওপরে লেখা— ‘মেরা সাথি নেহি’। আর একঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে দূর আকাশে। ওই একা পাখিটা যে ওর নিজেরই প্রতীক, বুঝতে অসুবিধা হয় না। জিজ্ঞাসা করি, ‘‘তোমার নাম কী?’’ গাছবাবা জানালেন, দিলীপ লোহার। অস্ফূটে বলে উঠলাম— ‘‘না না, তুমি লোহার নয়, তুমি তো সোনার। সোনার দিলীপ।’’ শিশুর মতো হাসতে থাকল গাছবাবা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

travel raimatang
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE