Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ট্রাক চুরিতে ত্রস্ত রাতের হাইওয়ে

গত ক’বছরে রাজ্যের বিভিন্ন জাতীয় সড়কে ট্রাক ছিনতাইয়ের ঘটনা রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে মালিক ও চালকদের। অভিযোগ, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গভীর রাতে রাস্তায় ব্যারিকেড করে ‘কেস’ দেওয়ার নামে পুলিশের জুলুম।

সাবধান: বিপদ ওত পেতে থাকে যেখানে-সেখানে। রাত ঘনাতেই হাইওয়েতে ঝুঁকির যাত্রা। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

সাবধান: বিপদ ওত পেতে থাকে যেখানে-সেখানে। রাত ঘনাতেই হাইওয়েতে ঝুঁকির যাত্রা। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

দেবাশিস দাশ
শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৭ ১৩:২৩
Share: Save:

উলুবেড়িয়া থেকে ট্রাক বোঝাই কাগজ শিলিগুড়িতে পৌঁছে ফিরে আসার কথা ছিল চালকের। কিন্তু সেই ট্রাক আর ফিরল কই? আসানসোল থেকে শেষ বারের মতো ফোন করেছিলেন চালক মিঠু শেখ। কিন্তু পরের দিন থেকে আর যোগাযোগ করা যায়নি। গত নভেম্বরে নিখোঁজ হওয়া ওই ট্রাকের সন্ধান আজও মেলেনি। হদিস নেই চালকেরও।

হাওড়া থেকে প্লাস্টিক দানা বোঝাই করে গত ২২ মে মুম্বই রওনা দিয়েছিল ১০ চাকার নতুন ট্রাক। রাত ১২টা নাগাদ দিল্লি রোডে ওঠার পরেই চালক দেখেন, গার্ড রেল বসিয়ে পথ আটকানো। গতি কমাতেই একটি ম্যাটাডর এসে পথ আটকে দাঁড়ায়। নেমে আসে গামছায় মুখ ঢাকা চার-পাঁচ জন। প্রত্যেকের হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র। চালক ও খালাসিকে মারধর করে নামিয়ে দিয়ে ট্রাক নিয়ে পালায় তারা।

গত ২১ মার্চ বৈদ্যবাটীর কাছে দিল্লি রোডে ১০ চাকার ফাঁকা ট্রেলার দাঁড় করিয়ে ধাবায় খেতে গিয়েছিলেন চালক। মাঝরাতে খেয়েদেয়ে ফিরে দেখেন, গোটা ট্রেলার ‘ভ্যানিশ’।

গত ক’বছরে রাজ্যের বিভিন্ন জাতীয় সড়কে ট্রাক ছিনতাইয়ের ঘটনা রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে মালিক ও চালকদের। অভিযোগ, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গভীর রাতে রাস্তায় ব্যারিকেড করে ‘কেস’ দেওয়ার নামে পুলিশের জুলুম। যার ফলে ট্রাকমালিক ও চালকদের কাছে রাতের হাইওয়ে হয়ে উঠেছে আতঙ্কের সড়ক। হাওড়া-হুগলি থেকে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার অধিকাংশ সড়কই এই তালিকায়। অভিযোগ, রাজ্য পুলিশের কর্তাদের বারবার জানিয়েও ফল মেলেনি। দু’এক বার কয়েক জন দুষ্কৃতী ধরা পড়লেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অধরা দলের পাণ্ডারা। অন্য দিকে, বন্ধ হয়নি রাতপাহারায় থাকা পুলিশের ‘দাদাগিরি’ও। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, হাইওয়ে থেকে ট্রাক চুরি ও পুলিশি জুলুমের অভিযোগে বৃহত্তর আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন ট্রাকমালিকদের সংগঠন ‘ফেডারেশন অব ট্রাক অপারেটার্স অ্যাসোসিয়েশন’।

ওই সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক সজল ঘোষ বলেন, ‘‘হাইওয়েতে পুলিশি জুলুমের জন্য যে হারে টাকা গুনতে হচ্ছে, তাতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে পরিবহণ শিল্পের। বৃহত্তর আন্দোলন ছাড়া এই শিল্পকে আর বাঁচানো সম্ভব নয়।’’

ট্রাক ছিনতাইয়ের ঘটনা যে প্রায়ই ঘটছে এবং এর পিছনে কয়েকটি দুষ্কৃতী দল সক্রিয়, তা মানছেন রাজ্য পুলিশের ডিআইজি (অপারেশনস) নিশাত পারভেজ। তিনি বলেন, ‘‘ট্রাকচোরদের ধরপাকড় চলছে। কয়েক জন ধরা পড়েছে। নিত্যদিন নতুন নতুন দল গজিয়ে উঠছে।’’

পুলিশ সূত্রের খবর, হাইওয়েতে ট্রাক চুরির ঘটনা বেশি ঘটছে বিভিন্ন টোল প্লাজার আগে এবং নিরিবিলি ধাবার সামনে। টোল প্লাজার আগে গাড়ির গতি একটু কমলেই যেন রাস্তা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে আগ্নেয়াস্ত্রধারী দুষ্কৃতীরা। ট্রাক থামিয়ে চলে মারধর, লুঠপাট। তার পরে সেই ট্রাক
নিয়ে পালায় লুটেরার দল। অনেক সময়ে চালককে ভয় দেখিয়ে তাঁকে নিয়েই চম্পট দেয় তারা। পরে সুযোগ বুঝে তাঁকে মারধর করে বা মাদক খাইয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। অনেক সময়ে চালকেরা যখন কোনও ধাবার কাছে ট্রাক রেখে খেয়ে বিশ্রাম নিতে যান, তখন নিঃশব্দে ট্রাক নিয়ে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা।

ট্রাকমালিকদের ওই সংগঠনের অভিযোগ, গত ছ’মাসে তাদের সদস্যদের প্রায় আটটি ট্রাক লোপাট হয়ে গিয়েছে। এ ছাড়া, অন্যান্য সংগঠনের আরও তিনটি ট্রাক ও চালকের সন্ধান মেলেনি। যার মধ্যে শুধু একটি ট্রাক পরে উদ্ধার করা গিয়েছে। সংগঠনের সভাপতি মোহিন্দর সিংহ গিল বলেন, ‘‘হুগলি ও বর্ধমানে গাড়ি কাটাইয়ের গোপন কারখানা রয়েছে। ট্রাক চুরির পরে ওই গোপন জায়গায় সেটি লুকিয়ে রাখে দুষ্কৃতীরা। সুযোগ বুঝে সেখানেই চলে গাড়ির রং ও নম্বর প্লেট তৈরির কাজ।’’ গিলের অভিযোগ, পুলিশের পক্ষ থেকে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। উল্টে ট্রাকে জিপিএস সিস্টেম লাগানোর জন্য মালিকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংগঠনের তিন লক্ষ সদস্যের সবাই কি জিপিএস লাগাতে পারবেন? পারলেও কি জাতীয় সড়কগুলি দুষ্কৃতীমুক্ত হবে?

উত্তর মেলেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE