Advertisement
E-Paper

বালুকে পিষতে এল কার গাড়ি

শুক্রবার সকাল সওয়া সাতটা। সময়টা জীবনভর মনে থাকবে। মেঘলা সকালে এক ঘণ্টা অনুলোম-বিলোম, কপালভাতি, ভস্ত্রিকা, ভ্রামরি-র যোগাভ্যাস পর্ব সেরে সল্টলেকের বিসি পার্কের কোণের বাড়ি থেকে সবে বেরিয়েছেন। পরনে হলুদ টি-শার্ট, সাদা ট্র্যাক।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৬ ০৫:০০
অঙ্কন: সুমন চৌধুরী

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী

শুক্রবার সকাল সওয়া সাতটা। সময়টা জীবনভর মনে থাকবে।

মেঘলা সকালে এক ঘণ্টা অনুলোম-বিলোম, কপালভাতি, ভস্ত্রিকা, ভ্রামরি-র যোগাভ্যাস পর্ব সেরে সল্টলেকের বিসি পার্কের কোণের বাড়ি থেকে সবে বেরিয়েছেন। পরনে হলুদ টি-শার্ট, সাদা ট্র্যাক। বিসি ব্লক কমিউনিটি সেন্টার পার হলেন। মিনিট কয়েক দাঁড়িয়ে দুই পড়শির সঙ্গে কুশল বিনিময় সেরে বাড়ির লেনে ঢুকেছেন কি ঢোকেননি, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বিপদসঙ্কেত দিল।

চোখ তুলেই এক ঝলকে দেখেন, সাক্ষাৎ শমন প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে আসছে! সেই অলিভ গ্রিন টাটা সুমো!

সঙ্গে সঙ্গে ‘রিফ্লেক্স অ্যাকশনে’ ডান দিকের ফুটপাথে লাফ। প্রায় গা-ঘেঁষে হুউউউউস করে বেরিয়ে গেল গাড়িটা। ধর ধর ধর, নম্বর নে, নম্বরটা নে...।

কিন্তু কোথায় সে? বরাতজোরে বড় বিপদের হাত থেকে যে বেঁচেছেন বুঝতে দেরি হল না পোড় খাওয়া রাজনীতিক তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের। ঘনিষ্ঠ মহলে যিনি বালু নামেই সমধিক পরিচিত।

গাড়িটির দেখা এই প্রথম নয়। আগের দিন, অর্থাৎ গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মধ্যমগ্রামে জেলা তৃণমূল অফিসের সামনে ও রাতে বিসি ব্লকেই মন্ত্রীর আর এক ডেরার দোরগোড়ায় গাড়িটি হাজির ছিল। সে দিন রাতে মন্ত্রীর এক অনুচর গাড়ির সওয়ারিদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা দু’টি ছেলে বলেছিল, মিনিস্টারের সঙ্গে ‘বাতচিৎ’ করতে এসেছি। ওদের পত্রপাঠ জানিয়ে দেওয়া হয়, মন্ত্রী অচেনা কারও সঙ্গে দেখা করবেন না।

বৃত্তান্ত শুনে পুলিশ এখন বলছে, সে রাতে মন্ত্রীকে ‘ফলো’ করেছিল গাড়িটা। তক্কে তক্কে ছিল। সকালে মওকা বুঝে ‘অ্যাটাক’ করেছে। কেন?

হাবরার বিধায়ক তথা উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের সভাপতি জ্যোতিপ্রিয়বাবুর অনুমান, এ হল সীমান্তে দুষ্কৃতী দমন অভিযানের জের। তাঁর কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গরু পাচার রুখতে কড়া হতে বলেছেন। সীমান্তে ব্যাপক ধড়পাকড় চলছে। আংরাইলে ক’দিন আগে এক পাচার-চাঁই ধরা পড়েছে। ওরাই আমাকে টার্গেট করতে পারে।’’

অনুমানের ভিত্তিও ব্যাখ্যা করেছেন মন্ত্রী। ‘‘গাড়িটা টানা দু’দিন আমাকে ফলো করেছে। লুঙ্গি পরা দু’জন আর জামা-প্যান্ট পরা জনা দুয়েক ছোকরা গাড়িতে ছিল। বার বার দেখা করতে চাইছিল। খবর পেয়েছিলাম, ওরা পাচার-চক্রে রয়েছে।’’— বলেছেন তিনি। লুকোননি বিস্ময়ও— ‘‘অনেকেই তো মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চায়। এ ভাবে কেউ মারতে আসবে, ভাবা যায়!’’

এ যাত্রায় তিনি রক্ষা পেলেও ঘুম ছুটেছে পুলিশ-প্রশাসনের। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের খবর, শুক্রবার সকালে ওই ঘটনার পরে প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে খাদ্যমন্ত্রী দ্রুত বাড়ি চলে যান। দেহরক্ষী বাড়িতে এলে তাঁকে সব জানান। রক্ষী মারফত কলকাতা পুলিশের ভিআইপি নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভাগে খবর যায়। লালবাজারের অফিসারেরা ছুটে আসেন সল্টলেকে। বিধাননগর কমিশনারেটেও বার্তা পাঠানো হয়। কোন গাড়ি হামলা চালাল, তা বার করতে দিনভর চিরুনি তল্লাশি চলে। সল্টলেক তো বটেই, আশপাশের তল্লাটেও তন্নতন্ন করে খোঁজ চলে।

জলপাই-সবুজ রঙের সাবেক মডেলের সুমোটির পাত্তা এখনও পাওয়া যায়নি। খাদ্যমন্ত্রী পুলিশে লিখিত অভিযোগও করেননি। তবে ‘সিকিওরিটি’র পরামর্শ মেনে গত শনি-রবিবার মর্নিং ওয়াক বাদ দিয়েছিলেন। সোমবার থেকে অবশ্য পুরনো রুটিনে ফিরে গিয়েছেন। আপাতত প্রতি দিন কাকভোর থেকে মন্ত্রীর বাড়ির আশপাশে সাদা পোশাকের পুলিশ মোতায়েন থাকছে বলে স্বরাষ্ট্র-সূত্রের খবর।

ব্যাপারটা মুখ্যমন্ত্রী কানেও পৌঁছেছে। নবান্ন-সূত্রের খবর, জ্যোতিপ্রিয়বাবুর সুরক্ষা জোরদার করতে রাজ্য পুলিশের ডিজি সুরজিৎ কর পুরকায়স্থকে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই মতো খাদ্যমন্ত্রীর ‘ওয়াই’ (থ্রেট বেসড) স্তরের নিরাপত্তা-বলয় পরবর্তী ‘জেড’ ক্যাটেগরিতে উন্নীত করার যায় কিনা, সে বিষয়ে নিরাপত্তা পর্যালোচনা কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে। পাশাপাশি পুলিশ নিজের মতো তদন্ত চালাচ্ছে। ‘‘সরকার কোনও অবস্থাতেই দুষ্কৃতীদের প্রতি নরম মনোভাব দেখাবে না। পুলিশকে আরও কড়া হতে বলা হয়েছে।’’— মন্তব্য মুখ্যমন্ত্রীর। পুলিশের কী পর্যবেক্ষণ?

পুলিশকর্তাদের একাংশও হামলার নেপথ্যে পাচার-চক্রের ভূমিকা দেখতে পাচ্ছেন। ‘‘রোজগারে কোপ পড়ায় ওরা মরিয়া।’’— বলছেন এক কর্তা। ওঁদের তথ্য অনুযায়ী, ফি মাসে বাংলাদেশি গরু পাচারকারীরা উত্তর ২৪ পরগনার আবালসিদ্ধিতে এসে ১২-১৫ কোটি টাকার ‘বখরা’ গুঁজে যায় কারবারে জড়িত বিভিন্ন পক্ষের হাতে। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের ফলে জেলায় পুরো পাচার-শৃঙ্খল নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। পরিণামে প্রবল চাপে পড়েছে চক্রের জনা বিশেক চাঁই। তাদের সব রাগ গিয়ে পড়েছে জেলায় শাসকদলের অন্যতম নেতা জ্যোতিপ্রিয়বাবুর উপরে। শুক্রবার তারই শোধ তোলার চেষ্টা হয়েছিল বলে পুলিশের এই মহলের প্রাথমিক ধারণা। তাঁরা জানাচ্ছেন, ঘটনার পরে পুলিশ আরও সক্রিয় হয়েছে। কারণ নবান্নের হুকুম— গরু পাচারে জড়িত কাউকে যেন রেয়াত করা না হয়, তা সে যে-ই হোক না কেন। প্রশাসনের আর এক অংশের বক্তব্য: সীমান্ত অঞ্চলে শাসকদলের নানা স্তরের নেতা গরু পাচারে জড়িত। ভোটের আগে পাচার-চক্র তাঁদের পিছনে মোটা টাকা ঢেলেছিল। ভোট মেটার পরে যখন তা সুদে-আসলে উসুল করার কথা, তখনই পুলিশ রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে। ‘বিনিয়োগ’ মাঠে মারা যাওয়ার জোগাড়। স্বভাবতই প্রতিক্রিয়া হয়েছে।

বস্তুত খাদ্যমন্ত্রী নিজেও এটা অস্বীকার করছেন না। তবে তাঁর সাফ কথা, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ স্পষ্ট। দলে থেকে পাচারে জড়ানো চলবে না। আইনি ব্যবস্থার জন্য তৈরি থাকতে হবে। জীবন সংশয় হলেও এ কথা বলে যাব।’’

jyotipriyo mallick
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy