১৯৭৩। কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোকে কলকাতা বিমানবন্দরে স্বাগত জানাচ্ছেন অশোক ঘোষ। ফাইল থেকে নেওয়া অলোক মিত্রের ছবি।
টেবিলের উপরে চেকবই একটু তেরছা করে ধরে আছেন এক জন। আর তিনি পেনটা তুলে সই করে দিচ্ছেন।
অর্বাচীন কোনও সাংবাদিক এক বার জানতে চেয়েছিলেন, তাঁর কখনও আশঙ্কা হয় না? তাঁর দৃষ্টিহীনতার সুযোগ নিয়ে যদি কেউ ভুল কিছুতে সই করিয়ে নেয়? স্বাক্ষরকারীর জবাব ছিল, ‘‘আমার দলে কে কী করতে পারে, আমি সব জানি! বিশ্বাসের উপরে চলে এটা।’’
অভূতপূর্ব বিশ্বাস এবং নিয়ন্ত্রণের টানটান সেই ইনিংস থেমে গেল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে। ই এম বাইপাসের ধারে বেসরকারি হাসপাতালের ভেন্টিলেশন মেশিনও যখন আর কাজে এল না। টানা ৬৫ বছর ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক থেকে, ৯৪ বছর বয়সে মৃত্যু হল অশোক ঘোষের। বামফ্রন্ট হোক বা তৃণমূল, বিজেপি থেকে কংগ্রেস, সব দলের নেতারা যাকে এক বাক্যে বলছেন— একটি যুগের অবসান।
রাজনীতিতে স্বীকৃত কোনও দলের শীর্ষ পদে টানা ৬৫ বছর দায়িত্ব সামলানো এ দেশের রাজনীতিতে নজিরবিহীন। এমনকী, বিশ্ব রাজনীতিতেও বিরল। তথ্যের খাতিরে দেখতে গেলে অশোকবাবুর দায়িত্ব নেওয়ার শুরু আসলে ১৯৪৮ সালে। তখন ফব-য় বিভাজন হয়ে একটি শাখার সম্পাদক ছিলেন অশোকবাবু। পাঁচের দশকের শুরুতে হরেন ঘোষের মৃত্যুর পরে আনুষ্ঠানিক ভাবে দলের রাজ্য সম্পাদক পদে আসেন তিনিই। দুই শাখাও তখন মিলে গিয়েছে। পদের নাম রাজ্য সম্পাদক হলেও ফব-য় অশোকবাবুই আসলে ছিলেন শেষ কথা। অশক্ত শরীর নিয়েও কেন এত দিন শীর্ষ পদে থাকবেন, তা নিয়ে দলে মাঝেমধ্যেই জলঘোলা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এমন আমৃত্যু ব্যবস্থা বিজ্ঞানসম্মত নয় মোটেও! কিন্তু ঐতিহাসিক তো বটেই।
শরীর অবশ্য জবাব দিতে শুরু করেছিল বেশ কিছু দিন ধরেই। এক মাস আগে শ্বাসনালীতে গুরুতর সংক্রমণ নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন হাসপাতালে। তখন থেকেই তাঁর ঠিকানা টানা আইসিইউ। তাঁর চিকিৎসার জন্য ৬ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। দীর্ঘ বহু বছর তাঁর ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি)-ও ছিল। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, গত কয়েক দিন ধরে তাঁর অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। বুধবার একাধিক বার চেষ্টা করেও তাঁর ডায়ালিসিস করানো যায়নি। শেষ পর্যন্ত দেহের বিভিন্ন অঙ্গ বিকল হয়ে এবং সেপ্টিসেমিয়ার জেরে এ দিন মৃত্যু হয় অশোকবাবুর।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেল খেটেছিলেন। ছয়ের দশকে যুক্তফ্রন্ট এবং ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার অন্যতম স্থপতি ছিলেন অশোকবাবু। প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে রাজনৈতিক যুগলবন্দি চালিয়েই বাম শিবিরে প্রভাবশালী নেতা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। জ্যোতিবাবুর মৃত্যুর পরে তাঁকেই বামফ্রন্টের ‘অভিভাবক’ মনে করতেন বিমান বসুরা। এমনই সমাপতন যে, এ দিন যখন আলিমু্দ্দিনে বামফ্রন্টের বৈঠক চলছে, তার মধ্যেই অশোকবাবুর মৃত্যু সংবাদ আসে। আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা শিকেয় তুলে হাসপাতালে দৌড়ন বিমানবাবু, সূর্যকান্ত মিশ্র, ক্ষিতি গোস্বামী, মনোজ ভট্টাচার্য, মঞ্জুকুমার মজুমদার, নরেন চট্টোপাধ্যায়, হাফিজ আলম সৈরানিরা। গিয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়াও। হাসপাতাল থেকে এ দিন অশোকবাবুর মরদেহ নিয়ে এসে রাখা হয়েছে পিস হেভ্নে। ভিন্ রাজ্যের নেতা-কর্মীদের এসে পৌঁছনোর সুযোগ দেওয়ার জন্য এক দিন সময় রাখা হচ্ছে হাতে। অশোকবাবুর দেহ অন্তিম শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ফব-র রাজ্য দফতর হেমন্ত বসু ভবনে এনে রাখা হবে কাল, শনিবার সকালে। দুপুরে সেখান থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত শোকমিছিল। তার পরে চুঁচুড়ায় তাঁর বোনের বাড়ি হয়ে রাতে দেহ পৌঁছবে পুরুলিয়ায় ফব দফতরে। পর দিন রবিবার পুরুলিয়ার সুইসায় সুভাষ আশ্রমে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হবে তাঁকে। দেহান্তে ওই আশ্রমের মাটিতে মিশে যাওয়াই ছিল অশোকবাবুর ইচ্ছা।
প্রবীণতম বাম নেতার মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছে সিপিএমের পলিটব্যুরো। শোকবার্তা দিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী, সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য। ভিড় এড়িয়ে সন্ধ্যায় পিস হেভ্নে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সচরাচর মর্গ বা শব সংরক্ষণাগার এড়িয়ে চলেন। তবে অশোকবাবুর জন্যই তিনি প্রথা ভেঙেছেন। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে পাশে নিয়ে প্রয়াত নেতার মরদেহে শ্রদ্ধা জানিয়ে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। শেষকৃত্যের সময় তাঁর দুই মন্ত্রীকেও উপস্থিত থাকতে বলেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর স্মৃতিচারণ, ‘‘অনেক বার অশোকদা’র কাছে এসেছি। ব্যক্তিগত ভাবে উনি আমাকে খুবই ভালবাসতেন।’’ তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘রাজনৈতিক বটবৃক্ষ ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে আত্মীয় বিয়োগের যন্ত্রণা হচ্ছে।’’
আত্মীয় বিয়োগের যন্ত্রণা নিয়েই পিস হেভ্নে অশোকবাবুর মরদেহ ঢুকে যাওয়ার পরে সেখানে এসে হাজির হয়েছিলেন আরও এক জন। দরজা খুলিয়ে ভিতরে ঢুকেছিলেন। অশোকবাবুর জন্মদিনে নিজের হাতে পায়েস রেঁধে খাওয়ানো ছিল তাঁর বহু দিনের অভ্যাস। সে অভ্যাসে চিরবিচ্ছেদের পরে রবিবার বামফ্রন্টের বৈঠক ডেকে রেখেও তাঁর প্রিয় ‘অশোকদা’র জন্য পুরুলিয়া যাবেন তিনি। শবাগারের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এ দিন তাঁর ঘোষণা, ‘‘মানুষের জোট আমাদের গড়তে হবেই। অশোকদার সম্মতি ছিল মানুষের জোটে।’’ অভিভাবকের ব্যাটন তো এখন বিমানবাবুর হাতেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy