বান্দু নদীর বালি খুঁড়ে জল খোঁজার চেষ্টা। পুরুলিয়ার বীরচালি গ্রামে। ছবি: সুজিত মাহাতো
বাড়ির পাশে সেচের খাল। শুকিয়ে খটখটে। অগভীর নলকূপও জবাব দিয়েছে।
অগত্যা ধারকর্জ করে খেতের লাগোয়া একচিলতে জমিতে গভীর নলকূপ বসাচ্ছেন বর্ধমানের মহিউদ্দিন চৌধুরী। আউসগ্রামের ওই চাষির কথায়, ‘‘চাষের জল ছেড়ে দিন, খাওয়ার জলও শ্যালোয় (অগভীর নলকূপ) উঠছে না! সবাই ডিপ টিউবওয়েল বসাচ্ছে। মাঠে জল দেওয়া যাবে, তেষ্টাও মিটবে। সেচের জল কবে আসবে, তার তো ঠিক-ঠিকানা নেই!’’
এই মুহূর্তে দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষিজীবীদের প্রতীক মহিউদ্দিন। নভেম্বর ইস্তক বৃষ্টি না-হওয়ায় চারিদিকে ত্রাহি রব। জলাধারে জল নেই, তাই সেচ-খাল শুকনো। প্রচণ্ড গরমে জলস্তর তলানিতে চলে যাওয়ায় গভীর নলকূপই ভরসা।
আর এতেই পরিবেশবিদেরা বড় বিপদের গন্ধ পাচ্ছেন। ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার সংক্রান্ত বাম আমলের আইন শিথিল হয়েছে তৃণমূল জমানায়। চাষের জল জোগাতে ঢালাও অগভীর নলকূপ বসে গিয়েছে। তাদের শোষণে মাটির অগভীর স্তরে জল বাড়ন্ত। পরিবেশবিদের আশঙ্কা, ভূগর্ভস্থ জলভাণ্ডারের উপরে লাগামছাড়া অত্যাচার চললে শেষে গভীর নলকূপ বসিয়েও জল মিলবে না।
বস্তুত বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর ইতিমধ্যে সেই চরম সঙ্কটের মুখোমুখি। এমন হল কী করে?
রাজ্যের এক সেচ-কর্তা জানাচ্ছেন, দক্ষিণবঙ্গে এ বছর কয়েকটা কালবৈশাখী হলেও লাভ বিশেষ হয়নি। ঝড় বেশি হয়েছে, বৃষ্টি নামমাত্র। তার উপরে বৃষ্টির পরে-পরে তাপমাত্রা বিস্তর বেড়ে উল্টো বিপত্তি ঘটিয়েছে। জলের চাহিদা বেড়েছে। তা সামাল দিতে গভীর নলকূপ মারফত বেশি জল তুলে নেওয়ায় পরিবেশের দফারফা হওয়ার জোগাড়! এমনিতেই দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলা আর্সেনিক ও ফ্লুওরাইডপ্রবণ। সে তল্লাটে জলস্তরের ভারসাম্য যত ধাক্কা খাবে, ভূগর্ভস্থ জলে দূষণের মাত্রা তত চড়বে বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা।
এখন সহায় হতে পারত বর্ষা। কিন্তু তার মতিগতি বোঝা ভার। রবিবারই মৌসম ভবন জানিয়েছে, দেশে বর্ষা ঢুকতে সপ্তাহখানেক দেরি করবে।
সব মিলিয়ে চাষিদের ঘরে ঘরে আক্ষেপের শেষ নেই। ‘‘সামান্য সব্জি লাগিয়েছিলাম। জ্বলে-পুড়ে খাক। এক ফোঁটা জল পেল না! দ্বারকেশ্বরের বুক খুঁড়েও কিছু পাচ্ছি না।’’— বলছেন পুরুলিয়ার নারায়ণগড় গ্রামের ছোটলাল মাঝি। কাড়াডি গ্রামের ভাস্কর মাহাতোও জানাচ্ছেন, জলের অভাবে তাঁর জমির সব কুমড়োর পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে। সেচের কী হল?
পুরুলিয়ার সেচ দফতরের সুপারিন্টেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার কৌস্তভজ্যোতি পালের ব্যাখ্যা, ‘‘গত বছর পুরুলিয়ায় খরার মতো অবস্থা হয়েছিল। জলাধারের জল নামতে নামতে ১৫% (ডেথ স্টোরেজ) পেরিয়ে গিয়েছে। সেচের জল দেওয়া যাচ্ছে না।’’ একই হাল বাঁকুড়ায়। দু’-এক দিনের সামান্য বৃষ্টি যেন সিন্ধুতে বিন্দু। মুকুটমণিপুরে কংসাবতী ব্যারাজের জলস্তর এখনও সেই তলানিতে। ফলে ক্যানালে জল ছাড়া যাচ্ছে না। দ্বারকেশ্বর-কংসাবতীর দু’পাড়ে বিরাট কৃষিজমি সেচের জল না-পেয়ে ফুটিফাটা। হিরবাঁধ, সালুইপাহাড়ি, মিরজি, মালিয়াম, গোপালপুর, দেউলভাঙার মতো বহু গ্রাম কার্যত নির্জলা। অগভীর তো বটেই, সেখানে গভীর নলকূপেও জল উঠছে না।
পশ্চিম মেদিনীপুরেও নানা এলাকায় জলস্তর পাতালে নেমেছে। নাগালই পাওয়া যাচ্ছে না। চাষের খেতে জল দূরের কথা, গলা ভেজানোই দায়। সবচেয়ে দুর্দশা বেলপাহাড়ি ব্লকে। জেলায় গত বছরও আমন চাষ মার খেয়েছিল। গত বছর কিন্তু আমন ধান রোয়ার কাজটা ভালই হয়েছিল। গাছ বেড়ে ওঠার সময়ে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না-হওয়ায় বেশির ভাগ ধান মাঠেই শুকিয়ে যায়। এ বার বর্ষা দেরি করলে আমন ধান রোপণই ধাক্কা খাওয়ার সমূহ আশঙ্কা।
জঙ্গলমহলের ৬৮% জমিতে স্থায়ী সেচের বন্দোবস্ত নেই। বৃষ্টি এত কৃপণ হলে সেখানে হাহাকার ওঠা আশ্চর্যের নয়। কিন্তু যেখানে সেচের জাল বহুবিস্তৃত, ‘রাজ্যের শস্যভাণ্ডার’ সেই বর্ধমানের একাংশেও নাভিশ্বাস! যে কারণে আউসগ্রামের মতো ‘সুজলা-সুফলা’ জায়গায় বাড়ি বাড়ি গভীর নলকূপ বসানোর ধুম! প্রশাসনের কী বক্তব্য? বর্ধমান জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, ‘‘বর্ধমানের কৃষিপ্রধান অঞ্চলের কোথাও পানীয় জলের আকাল পড়েছে, এমন খবর আমার কাছে নেই। শিল্পাঞ্চলে পানীয় জলের সঙ্কট রয়েছে।’’ তবে সেচের জলে যে সর্বত্রই টান, কর্তাটি তা স্বীকার করেছেন। ‘‘ব্যারাজগুলোই তো শুকনো!’’— বলছেন তিনি।
পরিত্রাণের জন্য সকলে আকাশের দিকে তাকিয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy