Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

গ্রামে ফিরেও আতঙ্কে ঘরছাড়ারা

পাঁচ বছর পর বাড়ি ফিরেছেন বিবেকানন্দ প্রধান। ফেরার মতো সাহসটুকু অবশ্য ছিল না। ১৬ মার্চ প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে তবে ঘরে ঢুকেছেন। কেমন আছেন তাঁরা?

গোবর্ধন জানা (বাঁ দিকে) ঘরছাড়াদের সঙ্গে কথা বলছেন প্রশাসনিক কর্তারা (ডান দিকে) ছবি: সোহম গুহ।

গোবর্ধন জানা (বাঁ দিকে) ঘরছাড়াদের সঙ্গে কথা বলছেন প্রশাসনিক কর্তারা (ডান দিকে) ছবি: সোহম গুহ।

সুব্রত গুহ
কানাইদিঘি শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৬ ০২:০৩
Share: Save:

পাঁচ বছর পর বাড়ি ফিরেছেন বিবেকানন্দ প্রধান। ফেরার মতো সাহসটুকু অবশ্য ছিল না। ১৬ মার্চ প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে তবে ঘরে ঢুকেছেন। কেমন আছেন তাঁরা?

বিবেকানন্দবাবুর অভিজ্ঞতা বলছে, গ্রাম বদলায়নি একচুলও। গোটা গ্রাম জুড়ে তৃণমূলের সন্ত্রাস আগের মতোই। ‘দাদা’দের ভয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষও কেমন সিঁটিয়ে রয়েছেন। দু’দিন পাড়ার চায়ের দোকানে গিয়েছিলেন বিবেকানন্দবাবু। চা দিয়েছে দোকানি। কিন্তু ওইটুকুই। চুপচাপ চা খেয়ে আসতে হয়েছে। ‘‘চায়ের দোকানেও কেউ আমাদের সঙ্গে ভয়ে কথা বলেনি। গ্রামে ফিরেও কার্যত একঘরে হয়েই রয়েছি”, আক্ষেপ লুকোননি বিবেকানন্দবাবু।

নিজের গ্রামটাই এখন অচেনা। বিবেকানন্দবাবু একা নন। সে দিন ঘরে ফিরেছিলেন আরও ২৩জন বামকর্মী। যাঁরা সকলেই ২০১১ সাল থেকে ঘরছাড়া ছিলেন তৃণমূলের ভয়ে। অবস্থা দেখে গিয়েছেন স্বয়ং পুলিশ সুপার। গত শুক্রবার জেলা পুলিশ সুপার উত্তর কানাইদিঘি গ্রামে রুট মার্চ করে যাওয়ার সময় কথা বলে যান বিবেকান্দবাবুদের সঙ্গে। কিন্তু পুলিশকর্তার অভয়বাণীর সঙ্গে বাস্তবের অমিলও অনেকটা।

রুটমার্চের ১৮ ঘণ্টা পর শনিবার ওই গ্রামে ছিল শীতলা পুজো। ধুমধাম করে পুজো। গ্রামের মানুষ সকলেই এসেছেন। ব্রাত্য শুধু ঘরে ফেরা ২৩টি বাম সমর্থক পরিবার। গ্রামে দাঁড়িয়েই বিবেকানন্দবাবু জানালেন, “পুজোয় আমাদের ডাকা হয়নি। এমনকী গ্রামের লোকজনের সঙ্গে দেখা হলেও কেউ কথা বলছেন না আমাদের সঙ্গে। কথা বললে তাঁরাও বিপদে পড়বেন।”

খোদ পুলিশ সুপার বাড়িতে বলে গিয়েছিলেন, ‘‘যাকে তোমার পছন্দ হবে তাকেই নির্ভয়ে ভোট দেবে। তোমার ও তোমার পরিবারের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের।” কিন্তু মাথার মধ্যে এখন একটাই কথা শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘‘ভোটের পরও আমরা গ্রামে থাকতে পারবো তো?’’ সে দিন অলোক রাজোরিয়াকেও এই প্রশ্নই করে ফেলেছিলেন বিবেকানন্দ। ফিরে এসেছে আশ্বাস, “নির্বিঘ্নে ভোট দাও। আমরা তো আছি।” ভয় কাটে না। তাই শুধু আধাসামরিক বাহিনীর টহলে সন্তুষ্ট থাকতে পারছেন না বিবেকানন্দবাবুরা। গ্রামে পুলিশ ক্যাম্প বসানোর দাবি জানিয়েছেন ঘরে ফেরা ঘরছাড়ারা।

‘বদলা নয়, বদল চাই’ পরিবর্তনের এই স্লোগানের মধ্যেই শাসক তৃণমূলের অত্যাচারে ২০১১ সালে ঘরছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন উত্তরকাঁথি বিধানসভা কেন্দ্রের কাঁথি-৩ ব্লকের উত্তর কানাইদিঘি গ্রামের বিবেকানন্দ প্রধান-সহ ৩৭ জন বামকর্মী। ১৬ মার্চ দুপুরে প্রশাসনের সাহায্যে ২৩ জন ঘরে ফিরেছিলেন।

সে সময় নিজের সব কিছু ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন বিবেকানন্দবাবু। রোজগারের একমাত্র পথ ছিল একটি ইঞ্জিন রিকশা। তাও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। মোটা টাকা জরিমানাও হয়েছিল। স্কুল পড়ুয়া একমাত্র ছেলেকেও সে সময় শুনতে হয়েছিল অনেক কটূ কথা। সেই ছেলে এখন কলেজে পড়ে।

বিবেকানন্দবাবুর সঙ্গেই পাঁচবছর পর ঘরে ফিরছেন উত্তর কানাইদিঘির ৭৮ বছরের বৃদ্ধ গোবর্ধন জানা। বামপন্থী হওয়ার ‘অপরাধে’ শাসক তৃণমূল তিনলক্ষ টাকা জরিমানা করেছিল তাঁকে। না দিতে পারায় দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ঘর ছাড়তে বাধ্য হতে হয়েছিলেন। শনিবার দুপুরে গ্রামের বাড়িতে বসে জানালেন, ‘‘গত মাসে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়। শেষ দেখাটাও দেখতে পাইনি। শাসক দলের নির্দেশে গ্রামে ঢোকাই নিষেধ ছিল আমার ও দুই ছেলের।” গোবর্ধনবাবুর দুই ছেলে মানিক ও মানসও মাকে শেষবার দেখতে পাননি। উপস্থিত থাকতে পারেননি সৎকার বা শ্রাদ্ধে। বাড়িতে ছিলেন ছোটভাই। সে-ই যা করার করেছে।

পাঁচ বছর আগে একমাত্র ছেলের অন্নপ্রাশনের কয়েক দিন আগে ঘর ছাড়তে হয়েছিল মানিক জানাকে। বাড়ি ফিরে মানিক দেখলেন পাঁচ বছরের ছেলেকে। “সে দিনের অত্যাচার ভোলার নয়, আমার বৃদ্ধ বাবা ও আমাদের কি নৃশংস ভাবে মারধর করেছিল ওরা”। পাঁচ বছর পর বাড়ি ফিরেছেন তাঁরা। তবু আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না ঘরফেরাদের।

কেমন আছেন আপনারা? বৃহস্পতিবার উত্তর কানাইদিঘি গ্রামে দীর্ঘদিন বাদে গ্রামে ফিরে আসা সিপিআই নেতা হংসপদ জানা ও ননীগোপাল জানাদের বাড়িতে হাজির হয়ে প্রশ্ন করলেন কাঁথির মহকুমাশাসক ও নির্বাচন সরিৎ ভট্টাচার্য। সিপিআই নেতা হংসপদ জানা বলেন, “গ্রামে ফিরে আসার পর তারা কার্যত গ্রামে একঘরে হয়েই আছেন। গ্রামের মানুষজন শাসক তৃণমূলের ভয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন।’’ মহকুমাশাসকের সঙ্গে থাকা এসডিপিও ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় বলেন, “পুলিশ প্রশাসনকে জানালে পুলিশ প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।’’ ভয় কি তবু এত সহজে ভাঙে। ঘরে ফেরাদের প্রশ্ন শুধু একটাই, ‘‘ভোটের পর আধাসামরিক বাহিনী চলে গেলে ফের ঘর ছাড়তে হবে না তো আমাদের?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

panic villagers homeless
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE