ছিটমহলে উৎসবের মেজাজ
মেয়ের বিয়ের রাতের কথা উঠতেই চোখ ছলছল হয়ে ওঠে মধ্য মশালডাঙার বাসিন্দা জাবেদা বিবির। জাবেদার মেয়ে কাবিনার বিয়ে ঠিক হয়েছিল দিনহাটার বাসিন্দা এক যুবকের সঙ্গে। বিয়ের সমস্ত আয়োজনও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিয়ের দিন পাত্র বেঁকে বসেন। তাঁর কথা ছিল, ছিটমহলের পাত্রীকে বিয়ে করলে সারা জীবন ধরে নানা সমস্যায় ভুগতে হবে। কাবিনার সঙ্গে পরে বিয়ে হয় অন্য এক ছিটের বাসিন্দার। কিন্তু শুধু ছিটের বাসিন্দা হওয়ার সেই অপমান এখনও ভুলতে পারেননি কাবিনা। ভুলতে পারেননি জাবেদাবিবিও। তিনি বলেন, ‘‘পুলিশের কাছে অভিযোগও জানাতে পারিনি। ছিটমহলের বাসিন্দা হওয়ার অভিশাপ সারা জীবন ধরে বয়ে বেড়াচ্ছিলাম। এ বার মুক্তি পাব।’’
ছিটমহলের বাসিন্দা বলেই এখানকার মহিলাদের আরও অনেক অপমান নিত্য সঙ্গী হয়েছে। দক্ষিণ মশালডাঙার ফিরদৌসী বিবি, মধ্য মশালডাঙার বানেচা বিবিদের বিয়ে হয়েছিল মূল ভূখণ্ডের পাত্রের সঙ্গে। কিন্তু স্বামী তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার পরেও তাঁরা পুলিশের দ্বারস্থ হতে পারেননি। সেই ছিটমহল বলেই। সব দেখেশুনেও ছিটমহলের নাগরিকত্বহীন অভিভাবকেরা অসহায়ের মতো শুধু চোখের জল মুছেছেন। মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে ন্যূনতম আইনি সাহায্যটুকুর ব্যবস্থাও করে উঠতে পারেননি।
নাগরিকত্বহীন জীবনে রেশন কার্ড, সচিত্র ভোটার কার্ড না থাকায় পাত্রপক্ষের অনেকে আবার বাড়তি ‘নগদ’ও দাবি করেছেন। এত দিন এমন ঘটনাই হয়ে উঠেছিল ছিটমহলের মেয়েদের অলিখিত বিধিলিপি। শুক্রবার ৬৮ বছরের নাগরিকত্বহীনতার অভিশাপ ঘুচেছে। ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশের সরকারের চুক্তি অনুযায়ী এ দিন মধ্য রাতে বিলুপ্ত হয়েছে ছিটমহলের অস্তিত্ব।
দুই দেশের ছিটমহল বিনিময় কার্যকর হয়েছে। আজ শনিবার ৫১টি ছিটমহলে সরকারি ভাবে প্রশাসনের কর্তাদের উপস্থিতিতে ভারতের জাতীয় পতাকা তোলা হবে। দেশের স্বাধীনতা দিবসের আগেই তাই স্বাধীনতার উৎসব চলল রাতভর। মোম, আতসবাজির আলোয় ঝলমল একেবারে অন্য রকম ছিটমহল। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির আলোক উৎসবের মতোই এ বার ছিটমহলের মেয়েদের জীবনের অন্ধকার দশা ঘুচিয়ে নতুন ভোরের প্রত্যাশায় বুক বাঁধছেন জাবেদা, বানেচা, ফিরদৌসীরা। প্রকাশ্যে শপথ নিচ্ছেন মেয়েদের অসম্মান ও অসৌজন্য ঘোচানোর।
ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহকারী সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, “পুরো একটা নতুন অধ্যায়। মেয়েদের অধিকার রক্ষার জন্যও ছিটমহল বিনিময় জরুরি ছিল। এ বার বিয়ে ভেঙে দেওয়া কিংবা বিনা বাধায় বিয়ের পর ছিটমহলের মেয়েদের বাবার বাড়ি পাঠানোর সাহস কেউ পাবেন না।” বাবার বাড়ির এক চিলতে মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে দক্ষিণ মশালডাঙার ফিরদৌসী বিবি আধময়লা কাপড়ের আঁচল দিয়ে বারবার চোখ মোছার ফাঁকে কোনও ক্রমে বললেন, “টাকার দাবি পূরণ করতে না পারায় দু’টি বাচ্চাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছিটমহলের বাসিন্দা বলে থানায় অভিযোগ করতে পারব না বলে স্বামী হাসাহাসি করেছে। এত দিন কিছু করতে পারিনি। এ বার নাগরিকত্বের সমস্যা ঘুচল। দরকারে পুলিশে অভিযোগ জানাব। যাতে আমার মতো ছিটমহলের আর একটা মেয়েকেও মুখ বুজে বাবার বাড়ি ফিরতে না হয়।”
মধ্য মশালডাঙার প্রবীণা জাবেদা বিবি, আঞ্জুয়ারা বিবিরাও একজোট। জাবেদা বলেন, “ঘটকের মাধ্যমে মেয়ে কবিনার বিয়ে ঠিক করেছিলাম। আয়োজনও হয়ে যায়। বিয়ের রাতে ছিটমহলের পাত্রীকে বিয়ে করলে নাগরিকত্বের সমস্যা হবে জানিয়ে পাত্র আপত্তির জানায়। নিমেষে মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। কিছু ক্ষণ শুধু কেঁদেছিলাম। শেষে কচুয়া ছিটের এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে কোনও মতে মান বাঁচে। ছিটমহলের বাসিন্দা বলে আইনের সাহায্য নিতে পারিনি। এমন পরিস্থিতি আর হতে দিচ্ছি না।”
জাবেদার পাশে দাঁড়ান আঞ্জুয়ারা সহ আরও কয়েক জনও। এক সঙ্গে মাথা নেড়ে সম্মতি দেন। ছিটমহলের বাসিন্দাদের এমন সমস্যায় যাতে পড়তে না হয়, সে ব্যাপারে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন তৃণমূলের নাটাবাড়ির বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর আন্তরিক উদ্যোগেই ছিটমহল বিনিময় সম্ভব হয়েছে। এখন থেকে ছিটমহলের মেয়েদের জীবন হবে আলোকিত। শিক্ষা প্রসার থেকে স্বনির্ভরতা সবেতেই রাজ্য সরকার পাশে থাকবে।”
ছিটমহলে উৎসবের আরও ছবি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy