Advertisement
E-Paper

ওই পথে উয়ারা এসেছিল, ভোট এলে মনে পড়ে

অযোধ্যা পাহাড়ে সন্ধ্যা নামতে তখনও খানিকটা দেরি। নীল-সবুজ পাহাড় ঘেরা গ্রামটার মোদকপাড়ার জটলা তবু আলো থাকতেই বেমালুম পাতলা হয়ে গেল।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:৪১
স্ত্রী চপলাকে এখােনই মেরেছিল মাওবাদীরা। বাগবিন্ধ্যায় নিজের বাড়িতে দেখাচ্ছেন দুখু গড়াইত। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

স্ত্রী চপলাকে এখােনই মেরেছিল মাওবাদীরা। বাগবিন্ধ্যায় নিজের বাড়িতে দেখাচ্ছেন দুখু গড়াইত। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

অযোধ্যা পাহাড়ে সন্ধ্যা নামতে তখনও খানিকটা দেরি। নীল-সবুজ পাহাড় ঘেরা গ্রামটার মোদকপাড়ার জটলা তবু আলো থাকতেই বেমালুম পাতলা হয়ে গেল।

গ্রামের কিনারে গোপাল বাঁধের জলে এ সময়টা মেয়ে-পুরুষের দঙ্গল থিকথিক করে। আর গড়াইতপাড়ায় বাঁশের ছাউনির নীচে জমে ওঠে কল ব্রিজের আসর। রবিবারের ছবিটা কিন্তু আলাদা। সুনসান গোটা গ্রাম। বোঝা গেল, বিধানসভা ভোটের প্রাক্‌-সন্ধ্যায় ঝালদা শহরের অদূরে বাগবিন্ধ্যা গ্রাম অন্তত ছিটেফোঁটা ঝুঁকির পথে হাঁটবে না। ভোটের আগের রাত বলে কথা! প্রৌঢ় বাবা দুখু গড়াইত তাই দুই মেয়ে চিন্তা ও লক্ষ্মীকে সাত-তাড়াতাড়ি বাড়ি ঢুকে যেতে বললেন। রাজ্যের প্রান্তিক জনপদে প্রথম বারের ভোটার দুই তরুণী। দুখুর বড় দুই ছেলে বিজয় ও প্রথম— অবশ্য আগে ভোট দিয়েছেন। আর ছোটটির এখনও ভোটের বয়স হয়নি।

ছ’বছর আগের সেই রাতে পাঁচ ভাইবোনই মাতৃহারা হন। সবাইকে খেতে দিয়ে মা নিজের ভাতটা বাড়তে যাওয়ার ঠিক আগে ‘ওরা’ টেনে নিয়ে যায় তাঁকে।

বাড়ির সামনের পুকুরে ডুব দিয়ে এসে চিন্তা-লক্ষ্মীরা কিন্তু বাবাকে সাহস জোগাচ্ছিলেন এ দিন। ‘‘অত চিন্তার আছেটা কী? ‘সেন্ট্রাল ফোর্স’ আছে না?’’ দুখু তাতে কিছুটা খেঁকিয়েই মেয়েদের বকুনি দিলেন। তার পরে দূর থেকে আসা শহুরে আগন্তুককে বললেন, ‘‘শুনছি না কি, দু’দিন আগে ফোর্স গ্রামে ঢুকেছিল সন্ধ্যায়। কিছু টের পাইনি।’’ ঘরে শুয়ে ভারী বুটের ধুপধাপ শব্দে এ তল্লাটে অনেকেরই বুকটা আরও কাঁপে! কে জানে কখন, কারা আসে-যায়!

২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে এ গ্রামে মাওবাদীদের হাতে খুন হয়েছিলেন চিন্তা-লক্ষ্মীদের মা, ঝালদা-দঁড়দা গ্রাম পঞ্চায়েতের ফরোয়ার্ড ব্লক প্রধান চপলা গড়াইত। গ্রামের আরও তিন জনকে মেরেছিল তারা। সংলগ্ন এলাকার আরও তিন জন মাওবাদী হানার বলি হয়েছিলেন সে রাতে। সকলেই ফরোয়ার্ড ব্লক করতেন। দুখু বলছিলেন, ‘‘মুখোশ-ঢাকা একটা লোক শক্ত করে আমার হাত টেনে ধরে রেখেছিল। ডাং দিয়ে মারতে মারতে উয়াদের কাঁড়ার (মোষ) মতো নিয়ে যাচ্ছিল!’’ বাগবিন্ধ্যা থেকে কিছু দূরে পাহাড়ের নীচেই সবাইকে গুলি করা হয়।

অযোধ্যা পাহাড়ের সেই বাগবিন্ধ্যায় বড়-সড় রক্তপাত এখন অতীত। রাজ্যে পালাবদলের পরে মাওবাদীরাও কোণঠাসা। আজ, সোমবার শান্তিপূর্ণ, অবাধ, নির্বিঘ্ন ভোট হওয়া নিয়ে আত্মবিশ্বাসী জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তী। কিন্তু তিনিও বলছেন, ‘‘অযোধ্যা পাহাড় ও ঝাড়খণ্ডের জঙ্গল লাগোয়া এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর ব্যস্ততা থাকবেই।’’

খাতায়কলমে বাঘমু্ন্ডি, বলরামপুর, বান্দোয়ান ও জয়পুরের মতো চারটে বিধানসভা কেন্দ্র এখনও মাওবাদী-প্রভাবিত বলে চিহ্নিত। কমিশনের নির্দেশ, এ তল্লাটে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে কম করে এক সেকশন অর্থাৎ অন্তত ন’জন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান উপস্থিত থাকবেন। জেলাশাসকও জোর গলায় বলছেন, ‘‘ভোটারদের উপরে এ বার কিন্তু কারও জুলুম-নিষেধের ব্যাপার নেই। সেকশন অফিসাররা সজাগ আছেন, কোনও অভিযোগ এলেই সঙ্গে-সঙ্গে প্রশাসনের লোকেরা নিজে গিয়ে বুথে নিয়ে আসবে।’’

ভোটের আগের দিন কিন্তু জয়পুর থেকে অযোধ্যা পাহাড় বার কয়েক পাক খেয়েও কেন্দ্রীয় বাহিনীকে কার্যত দেখাই গেল না। পুরুলিয়ার আপাত শান্ত জঙ্গলমহলেও তাই প্রশ্নটা থাকছে—আতঙ্ক ঠেলে বুথ অবধি পৌঁছনো যাবে কি আজ?

এমনিতে ২০১১ সালে মাওবাদীদের ‘পরোক্ষ’ সমর্থনে ঝুলি উপুড় করে ভোট দিয়েছিল পুরুলিয়ার জঙ্গলমহল। এ বারও তার ব্যতিক্রম হবে না বলেই আশা প্রশাসন ও শাসকদলের। তবু বাগবিন্ধ্যায় বাঁধের জলে চান করতে আসা হুসেনডিহি গ্রামের যুবক তথা রাঁচির কলেজের ছাত্র শাহজামিল খান বললেন, ‘‘সিআইএসএফ আছে তো শুনেছি, সেই বেগুনকোদরে! গ্রামের ভিতরে কিছু ঘটলে, কে বাঁচাবে কে জানে!’’

কিন্তু, কী ঘটবে?

মাওবাদী এখন নেই বললেই চলে। তা হলে? বাঘমুণ্ডি পৌঁছনোর আগে বিরোধী জোটের শক্ত ঘাঁটি জয়পুরের আড়শায় ঘুরতে ঘুরতে কিছু কথা কানে এল। অনেকেই বললেন, ‘‘উয়ারা নেই তো কী হয়েছে! ঘাসফুল আছে তো! ভোট কোথায় দিতে হবে, তা তো বলেই দেওয়া হচ্ছে।’’ তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য এই অভিযোগ মানছেন না। আড়শার তৃণমূল কর্মী বুলবুল চক্রবর্তী বললেন, ‘‘পাহাড় ঘেরা এরিয়া নিয়ে চিন্তা তো আছেই!’’ তাঁর ইঙ্গিত অবশ্য মাওবাদীদের দিকে। পুরুলিয়ার বিরোধী জোটের প্রথম সারির মুখ তথা বাঘমুন্ডি কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী নেপাল মাহাতো সমানে আশ্বাস দিয়ে আসছেন, ‘‘ভোটের সময় কিন্তু মাওবাদীরা কখনওই এ তল্লাটে কিছু করেনি।’’ তাঁর প্রতিপক্ষ শাসক দলের সমীর মাহাতোর দাবি, ‘‘পুরুলিয়ায় আর মাওবাদী বলে কিছু নেই।’’

কিন্তু, ভোটের পটভূমিতে ওই ঘটনার স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে। পুরুলিয়া জেলা প্রশাসনের এক কর্তাই বলছিলেন, ‘‘বাঘমুণ্ডি, বলরামপুরে মাওবাদীরা এক সময়ে যে হিংসা দেখিয়েছে, তার স্মৃতি চট করে গ্রামবাসীদের যাওয়ার নয়।’’ বাগবিন্ধ্যাও তাই পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারছে না। গ্রামে প্রাথমিক স্কুলের বুথের সামনে দাঁড়িয়ে দূরে অযোধ্যা পাহাড়ের নীচে জঙ্গল দেখিয়ে বিশ্বনাথ মাহাতো বললেন, ‘‘ওই দিক থেকেই উয়ারা এসেছিল বটে। ভোট এলেই মনে পড়ে যায়!’’

election purulia maoist
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy