ধর্মঘটের সমর্থনে সভায় সিটু নেতা শ্যামল চক্রবর্তী। ধর্মঘট-বিরোধী তৃণমূলের মিছিলে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ও। শহরে মঙ্গলবার সুদীপ আচার্য ও শশাঙ্ক মণ্ডলের তোলা ছবি।
বিধানসভা ভোটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বামেরা এখন আগের চেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক। সঙ্গে আছে কংগ্রেসও। আজ, বুধবারের সাধারণ ধর্মঘট তাই একেবারে সম্মুখ সমর! সেই সমরের আগের দিন নিজেদের রণসজ্জা আরও জম্পেশ করে তুলল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় এখন দস্তুর, ধর্মঘটের দিন কাজে যোগ না-দিলে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের এক দিনের বেতন কাটা যাবে। চাকরি জীবন থেকেও এক দিন বাদ দিয়ে দেওয়া হবে (ডায়েজ নন)। প্রতি বারের মতো এ বারও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের ডাকা সাধারণ ধর্মঘট ব্যর্থ করতে এমন ফরমান জারি হয়েছে আগেই। তার উপরে মঙ্গলবার যোগ হল নতুন ফরমান। অর্থ দফতরের জারি করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আগে থেকে নিয়ে রাখা ছুটির সঙ্গে ধর্মঘটের দিনটি যোগ করে নিলেও সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে ‘অনুপস্থিত’ বলেই গণ্য করা হবে। এবং তাঁর ক্ষেত্রে পুরো ছুটিরই বেতন কাটা যাবে। চাকরি জীবন থেকেও ওই ক’টি দিন বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। এই বিজ্ঞপ্তিকে পত্রপাঠ ছিঁড়ে ফেলে ধর্মঘটে যোগ দেওয়ার পাল্টা আবেদন জানিয়েছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র!
ধর্মঘটের ঠিক আগের দিন এমন নজিরবিহীন ফরমানকে ঘিরে দিনভরই নানা জল্পনা চলেছে প্রশাসনের অন্দরে। সরকারি কর্মীদের একাংশের মধ্যে এই বিজ্ঞপ্তি ঘিরে অসন্তোষও তৈরি হয়েছে। যা নিয়ে বিব্রত এমনকী, শাসক দলের কর্মী সংগঠনের নেতারাও। সরকারি শীর্ষ কর্তাদের কেউই এই বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি। তবে নবান্নের শীর্ষ মহলের একাংশের ব্যাখ্যা, আজকের ধর্মঘট সফল করতে সিপিএম প্রভাবিত সরকারি কর্মী সংগঠন কো-অর্ডিনেশন কমিটির অনেকেই সোমবার থেকে ছুটিতে চলে গিয়েছেন। ওই সব কর্মীদের কাজে যোগ দেওয়া নিশ্চিত করতেই নতুন করে এই বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হয়েছে।
নবান্নের শীর্ষ কর্তাদের এই ব্যাখ্যায় অবশ্য সন্তুষ্ট নন অধিকাংশ সরকারি কর্মীই। শাসক দলেরই কর্মী সংগঠনের এক নেতার কথায়, ‘‘প্রথমে সরকার যে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল, তাতেই গত চার বছরে বিরোধীদের ডাকা ধর্মঘটে সরকারি সব দফতরে উপস্থিতির হার ৯০%-রও বেশি ছিল। যা সাধারণ দিনের থেকে বেশি। তা হলে নতুন এই বিজ্ঞপ্তি জারির প্রয়োজন কী ছিল!’’ সরকারের একটি অংশের ধারণা, এ বারের ধর্মঘট সফল করতে বেশ কিছু দিন ধরেই সরকারি কর্মীদের মধ্যে তলে তলে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছে কো-অর্ডিনেশন কমিটি। তার জেরে অনেক কর্মী কাজে যোগ দিতে না-ও পারেন, এই আশঙ্কা থেকেই কার্যত হুঁশিয়ারি দিতে নতুন এই বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হয়েছে সরকারকে।
সরকারি বিজ্ঞপ্তিকে হাতিয়ার করে বামেরাও পাল্টা বলতে শুরু করেছে, রাজ্য সরকার এ বার আরও ভয় পেয়েছে! তা ছাড়া, নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ডাকা ধর্মঘট ভাঙতে সরকার কেন এত মরিয়া, সেই প্রশ্নও তুলছে তারা। সূর্যবাবু এ দিন বলেন, ‘‘ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে মুখ্যমন্ত্রী যে সব নির্দেশিকা জারি করছেন, যেমন মাইনে কাটা হবে, চাকরি জীবনের এক দিন কাটা যাবে— এ সবের কোনও আইনগত ও সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। প্রতি বারেই আদালতে সরকারি নির্দেশ খারিজ হয়েছে।’’
নবান্নে এ দিনই মুখ্যসচিবের দফতরে চিঠি দিয়ে আইএনটিইউসি অনুমোদিত সরকারি কর্মী সংগঠন কনফেডারেশন অব স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ এবং কো-অর্ডিনেশন কমিটি-সহ ৩৫টি সংগঠন বকেয়া ডিএ-সহ ৭ দফা দাবি জানিয়েছে এবং ঘোষণা করেছে ওই ৭ দফা দাবির ভিত্তিতে আজ তারা ধর্মঘট পালন করবে। ধর্মঘটকে অবশ্য সমর্থন করছে না বিজেপি সমর্থিত সরকারি কর্মী সংগঠন। তাতেও খানিকটা বিব্রত তৃণমূল সমর্থিত কর্মী সংগঠনের নেতারা। কারণ, এই ঘটনাও বাম-কংগ্রেসের কাছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে যাচ্ছে!
ধর্মঘট ঘিরে এ দিন বিকাল থেকেই পুলিশি প্রস্তুতি তুঙ্গে। লালবাজার সূত্রের খবর, অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে শহরের ৩৫০টি জায়গায় পুলিশ পিকেট, ২৫টি রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড, ১২টি হেভি রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড থাকবে। কলকাতা পুলিশের সব ডিভিশনের ডেপুটি কমিশনার, সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি কমিশনারদেরও মোতায়েন করা হচ্ছে। যদিও ধর্মঘট ঘিরে উত্তেজনার পরিবেশে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে এ দিনই।
বর্ধমানের সালানপুর ও রূপনারায়ণপুর এ দিনই উত্তপ্ত হয়েছিল সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষে। সিপিএমের মিছিলে হামলা, লোকাল কমিটি কার্যালয়ে আগুন লাগানোর অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। সালানপুরের ডাবর মোড়ে ধর্মঘটের সমর্থনে এ দিন বিকালে মিছিল করছিল সিপিএম। বিরোধিতা করে পথসভা করছিল তৃণমূল। দু’পক্ষে সংঘর্ষ বাধে। সিপিএমের অভিযোগ, তাদের মিছিলে বোমা মারা হয়। সন্ধ্যায় হামলা হয় তাদের লোকাল কমিটি কার্যালয়েও। তৃণমূলের পাল্টা অভিযোগ, সিপিএম সমর্থকেরা তাদের লক্ষ করে ইট ছুড়েছে, লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালিয়েছে। তাদের বেশ কয়েকটি মোটরবাইকও ভাঙচুর করা হয়েছে। প্রশাসনিক সূত্রেরও দাবি, সিপিএমের মিছিলের অনুমতি ছিল না। তাদের দিক থেকেই ধর্মঘট-বিরোধী মিছিলের উপরে হামলা হয়। সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে মাথা ফাটে রূপনারায়ণপুর ফাঁড়ির আইসি অমিত হালদারের। তাঁকে দুর্গাপুরের এক নার্সিংহোমে পাঠানো হয়।
দিল্লির আবহ অবশ্য এতটা সংঘাতপূর্ণ নয়। ধর্মঘট প্রত্যাহারের মরিয়া আবেদন জানিয়ে এ দিন রাত ৮টা নাগাদ বরং শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের বাড়িতে দূত মারফত চিঠি পাঠিয়েছেন কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী বন্দারু দত্তাত্রেয়। প্রত্যাশিত ভাবেই সেই আবেদন মানছেন না ধর্মঘটীরা। শ্রমিক সংগঠনগুলির অধিকাংশ দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে বলে দত্তাত্রেয় যে দাবি করেছেন, তা-ও উড়িয়ে দিয়েছেন তাঁরা। বরং তাঁদের দাবি, রেল বাদে ব্যাঙ্ক, বন্দর, কয়লা, আয়কর, বিমা, তেল উত্তোলন, তেল ও গ্যাসের মতো ক্ষেত্রে ধর্মঘটের প্রভাব পড়বে। বাম ও কংগ্রেসের শ্রমিক নেতারা বলছেন, রাজনৈতিক চাপেই বিএমএসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে ধর্মঘট থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে। কিন্তু বহু রাজ্যে বিএমএসের স্থানীয় সংগঠনগুলি ধর্মঘটে অংশ নেবে। বিএমএসের সাধারণ সম্পাদক ব্রিজেশ উপাধ্যায় অবশ্য রাজনৈতিক চাপে ধর্মঘট থেকে সরে আসার অভিযোগ খারিজ করে দাবি করেছেন, তাঁদের সদস্যেরা ধর্মঘট করবেন না।
এই দাবি-পাল্টা দাবির মধ্যেই বড় প্রশ্ন, আজ এ রাজ্যে কী হবে? বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘সাধারণ মানুষ ধর্মঘট চান না। তাঁরাই ধর্মঘট ব্যর্থ করবেন।’’ আর শাসক দল ও পুলিশের প্ররোচনায় পা না দেওয়ার আবেদন জানিয়ে বামেদের তরফে সূর্যবাবুর বক্তব্য, ‘‘যাঁরা রাজ্যে শিল্প না হওয়া, কেন্দ্র ও রাজ্যের আর্থিক ও শিল্প-নীতি, আন্দোলনকারীদের উপরে লাঠি, জল-কামান সমর্থন করেন, তাঁরা ধর্মধটের বিরোধিতা করুন! কিন্তু যাঁরা এ সবের বিরোধী, তাঁরা ধর্মঘট সমর্থন করবেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy