Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

দত্তকের নামে বিক্রি, ‘বেনামি’ চিঠিতে তদন্ত

সরকারি ভাবে, তারা রক্ষক। কিন্তু আড়ালে কি তারাই ভক্ষক হয়ে উঠেছে? রাজ্যে অনাথ শিশুদের কিছু হোমের কাজ-কারবার সম্পর্কে এমন সন্দেহ দেখা দেওয়ায় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। অভিযোগ, দেখভালের নামে হোমগুলি বিদেশে বাচ্চা পাচার করছে।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৫ ০৩:১২
Share: Save:

সরকারি ভাবে, তারা রক্ষক। কিন্তু আড়ালে কি তারাই ভক্ষক হয়ে উঠেছে?

রাজ্যে অনাথ শিশুদের কিছু হোমের কাজ-কারবার সম্পর্কে এমন সন্দেহ দেখা দেওয়ায় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। অভিযোগ, দেখভালের নামে হোমগুলি বিদেশে বাচ্চা পাচার করছে।

এবং সরকারি পদক্ষেপের মূলে রয়েছে একটি চিঠি, সরকারি কর্তারা যাকে ‘বেনামি’ হিসেবে অভিহিত করছেন। আপাতদৃষ্টিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রীকে চিঠিটি লিখেছেন তাঁরই দফতরের এক সহ-অধিকর্তা। জানিয়েছেন, সরকারি খাতায় অনাথ শিশুদের হোম হিসেবে পরিচিত ও শিশু দত্তকদানের অনুমোদনপ্রাপ্ত ওই প্রতিষ্ঠানগুলি আদতে মোটা টাকার বিনিময়ে বিদেশে শিশু বিক্রি করছে। দফতরের কর্তাদের যদিও দাবি, তাঁদের কোনও সহ-অধিকর্তা চিঠিটি লেখেননি।

কিন্তু ঘটনা হল, সেই ‘বেনামি’ চিঠিরই ভিত্তিতে পাঁচ জেলায় ছড়িয়ে থাকা পাঁচটি হোমের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা কার্যত অভূতপূর্ব। সমাজকল্যাণ দফতরের তরফে সংশ্লিষ্ট পাঁচ জেলার জেলাশাসকের কাছে এ ব্যাপারে বিস্তারিত রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। মন্ত্রী-সহ বিভিন্ন কর্তার বক্তব্য, অভিযোগের গুরুত্বের নিরিখেই চিঠিটিকে স্রেফ উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

বস্তুত প্রেরকও মন্ত্রীকে লিখেছেন, ‘দয়া করে একে মামুলি ভাববেন না। আমার অভিযোগের গুরুত্ব কিন্তু অপরিসীম।’ কী রকম?

‘অবৈধ ও অনৈতিক’ কার্যকলাপের জন্য কিছু জেলার কয়েকটি হোম, সমাজকল্যাণ দফতরের কিছু কর্মী ও বিভিন্ন শিশুকল্যাণ কমিটির কিছু সদস্যের দিকে সরাসরি আঙুল তুলে প্রেরকের দাবি, মোটা টাকার বিনিময়ে শিশুদের দত্তক দেওয়ার চক্রে এরা জড়িত। চিঠির বয়ান মোতাবেক, ‘‘বিধি-নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এরা বিদেশিদের কাছে অনাথ শিশু দত্তক দিয়ে হাজার হাজার ডলার কামাচ্ছে। অথচ এখানকার বহু সন্তানকামী দম্পতি অত টাকা দিতে না-পারায় নানা অজুহাতে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন।’

হোমের পাশাপাশি নানা ব্যক্তির নামও উঠে এসেছে অভিযোগপত্রে। তাঁরা কেউ জেলার শিশুকল্যাণ পর্ষদের মাথা, কেউ বা সমাজকল্যাণ দফতরেরই স্থানীয় কর্মী। প্রশাসনের অন্দরের খবর, এঁদের মধ্যে রয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনা শিশুকল্যাণ পর্ষদের এক সদস্য ও বিকাশ ভবনে সমাজকল্যাণ দফতরের সদরে কর্মরত এক জন। হাওড়া শিশুকল্যাণ পর্ষদের এক সদস্যের নামও করা হয়েছে। বাদ যাননি তাঁর স্ত্রী-ও, যিনি কিনা হাওড়ারই এক শিশু দত্তক প্রতিষ্ঠানের সচিব।

এ হেন ‘বিস্ফোরক’ চিঠিটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজার অফিসে অবশ্য পৌঁছেছিল প্রায় পাঁচ মাস আগে— গত ফেব্রুয়ারিতে। চিঠির প্রতিলপি পাঠানো হয়েছিল রাজ্য ভিজিল্যান্স কমিশন, কেন্দ্রীয় সমাজকল্যাণ পর্ষদের যুগ্ম সচিব, কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ পর্ষদের চেয়ারম্যানকেও। এপ্রিলে ভিজিল্যান্স কমিশন দফতরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শেষমেশ গত জুনের শেষাশেষি ডিএম’দের কাছে তদন্তের নির্দেশ গিয়েছে। সূত্রের ইঙ্গিত, ভিজিল্যান্স তৎপর না-হলে চিঠিটি হয়তো ফাইলের তলায় এখনও চাপা পড়ে থাকত। ‘‘এত দিনে হয়তো অভিযুক্তদের কাছে চিঠির খবর ফাঁসও হয়ে গিয়েছে।’’— আক্ষেপ করছেন এক আধিকারিক।

তদন্ত এত দিন বাদে কেন ?

মন্ত্রীর জবাব, ‘‘চিঠিটার কথা জানতেই পারিনি! আশ্চর্য! অফিসারদের কাছেও ঠিকঠাক উত্তর পাইনি।’’ তাঁর বক্তব্য, এপ্রিলে ভিজিল্যান্সের থেকে ব্যাপারটা জানার পরেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল যে, তদন্ত হবে। ‘‘তবে সরকারি প্রক্রিয়ায় ডিএম’দের চিঠি দিতে একটু দেরি হয়েছে।’’— বলেন শশীদেবী। সমাজকল্যাণ-অধিকর্তা সোমনাথ মুখোপাধ্যায়ের দাবি: চিঠির প্রেরক সম্পর্কে বিস্তর ধোঁয়াশা। ‘‘আমাদের তিন জন অ্যসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। কেউই ওটা লেখেননি। ওই রকম সই কেউ করেনও না।’’— যুক্তি সোমনাথবাবুর।

তা সত্ত্বেও কেন তদন্ত?

শশীদেবীর ব্যাখ্যা, ‘‘চিঠিটাকে বেনামি মনে হলেও তাতে এমন কিছু ব্যক্তি আর হোমের নাম রয়েছে, যাদের নিয়ে আমাদেরও সংশয় আছে। অভিযোগও যথেষ্ট গুরুতর।’’ দফতরের সচিব রোশনি সেনের কথায়, ‘‘সত্যিই অভূতপূর্ব। আমরা সাধারণত বেনামি চিঠিকে গুরুত্ব দিই না। এ ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছে, কারণ অভিযোগ সাংঘাতিক।’’

তাই বীরভূম, বাঁকুড়া, হাওড়া ও দুই ২৪ পরগনার জেলাশাসকদের কাছে অভিযুক্ত হোম ও ব্যক্তিদের নাম পাঠিয়েছে দফতর। ডিএম’দের বলা হয়েছে, তদন্ত করে বিকাশ ভবনে রিপোর্ট জমা দিতে। কর্তারা জানাচ্ছেন, অভিযোগ প্রমাণিত হলে পুলিশে এফআইআর রুজু করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দোষী সাব্যস্ত হলে সংশ্লিষ্ট হোমের অনুমোদন বাতিল তো হবেই, শিশু পাচারের দায়ে কড়া শাস্তিও বাঁধা।

গত এক মাসে তদন্ত এগলো কতটা? হাওড়ার জেলাশাসক শুভাঞ্জন দাস বলেন, ‘‘সমাজকল্যাণ-কর্তাদের সঙ্গে অনেক বার আলোচনা হয়েছে। জেলা সমাজকল্যাণ আধিকারিক রিপোর্ট বানাচ্ছেন।’’ বীরভূমের জেলাশাসক পি মোহন গাঁধীর বক্তব্য, ‘‘আমরা তদন্ত শুরু করে দিয়েছি।’’ উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক ডিএম মনপ্রীত কৌর নন্দা বলেন, ‘‘এডিএমের নেতৃত্বে তদন্ত শুরু হয়েছে।’’

অভিযোগপত্রে উল্লিখিত বিকাশ ভবনের কর্মীর বিরুদ্ধে অবশ্য দফতর নিজেই তদন্তে নেমেছে। এতে সংশয়ও মাথা চাড়া দিয়েছে। ‘‘সর্ষের মধ্যে ভূত বার করার চেষ্টা ঠিকঠাক

হবে তো?’’— প্রশ্ন তুলেছে দফতরেরই একাংশ।

ওঁদের সংশয়ের নিরসন হয় কি না, সেটাই দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE