Advertisement
০৫ মে ২০২৪

সার্চ লাইট জ্বালতেই পিছিয়ে গেল হাতির দল

জঙ্গলে নির্বিঘ্নে বসবাসের অধিকার রয়েছে জীবজন্তুদের। তাদের শান্তি বিঘ্নিত হলে ঠেকানো উচিত বলেই মনে করেন বন আধিকারিক পূরবী মাহাতো। শুনলেন কিংশুক গুপ্তজঙ্গলে নির্বিঘ্নে বসবাসের অধিকার রয়েছে জীবজন্তুদের। তাদের শান্তি বিঘ্নিত হলে ঠেকানো উচিত বলেই মনে করেন বন আধিকারিক পূরবী মাহাতো। শুনলেন কিংশুক গুপ্ত

শিকার উৎসবে বহু প্রাণীর প্রাণ বাঁচিয়েছেন পূরবী মাহাতো। একবার সহকর্মীদেরও বাঁচিয়েছিলেন।

শিকার উৎসবে বহু প্রাণীর প্রাণ বাঁচিয়েছেন পূরবী মাহাতো। একবার সহকর্মীদেরও বাঁচিয়েছিলেন।

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৮ ০১:০৪
Share: Save:

মেদিনীপুর বন বিভাগের সহকারী বনাধিকারিক (এডিএফও) পূরবী। সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় চর্চায় এসেছিলেন চলতি বছরে আদিবাসীদের শিকার উৎসব ‘সেন্দ্রা’ ঠেকিয়ে। শিকার উৎসব ঠেকানোর মতোই বন আধিকারিক হিসেবে রোমাঞ্চকর নানা ঘটনার সাক্ষী তিনি। সেই ঘটনা মেদিনীপুরের।

গত সেপ্টেম্বরে পূরবীর তত্পরতায় তাঁর সহকর্মীরা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। বন আধিকারিক হিসেবে পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাতবিরেতে জঙ্গলে ডিউটিতে থাকেন তিনি। গত সেপ্টেম্বরে হাতির দলকে গুড়গুড়িপালের জঙ্গল থেকে সরানোর জন্য সহকর্মীদের সঙ্গে হুলাপার্টির তদারকিতে ছিলেন। সারাদিন ধরে হুলাপার্টি হাতির পিছনে পিছনে ঘুরেছে। রাতে তাদের শরীর আর বইছিল না। পরিশ্রান্ত কয়েকজন বনকর্মী চাঁদড়ার কাছে সাপকাটা চকে রাস্তার ধারেই শুয়ে পড়েন। সহকর্মীরা জোর করে পূরবীকে গাড়িতে ঘুমোতে পাঠান। সঙ্গে আরেক মহিলা আধিকারিকও ছিলেন। রাত তখন দু’টো। অপরিসর গাড়িতে কোনও মতে শুয়েছিলেন পুরবী। পা দু’টো জানালার বাইরে বেরিয়ে। ভয় পাচ্ছিলেন, হাতির হঠাৎ হামলার। আচমকাই তাঁর পায়ের কাছে কেমন যেন একটা অনুভূতি হয়। অন্ধকারে পূরবীর অভিজ্ঞ চোখ বুঝে যায় গাড়ির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে পাঁচটি হাতি। ভয় না পেয়ে চিৎকার করে সার্চ লাইট জ্বালাতে বলেন তিনি। আলোয় পিছিয়ে যায় হাতিগুলি। অকুতোভয় পূরবীর উপস্থিত বুদ্ধিতে নিশ্চিত অঘটনের হাত থেকে বাঁচেন রাস্তায় শুয়ে থাকা পাঁচ বনকর্মী।

আসলে ছোটবেলা থেকেই বন আর বন্যপ্রাণ সম্পর্কে একটা অনুভূতি কাজ করে পূরবীর মধ্যে। ছোটবেলা কেটেছে পুরুলিয়ার পাড়া থানার কালুহার গ্রামে। লালমাটির দেশের ভূমিকন্যা তিনি। ছোটবেলা থেকেই জঙ্গলমহলের প্রকৃতি ও বনাঞ্চলের মাঝেই বড় হয়েছেন। পূরবীর বাবা লালমোহন মাহাতো ছিলেন প্রাথমিক শিক্ষক। মা তিতুবালাদেবী পূরবীকে এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষাই দিয়ে গিয়েছেন। ছোটবেলাতেই শুনেছিলেন সেন্দ্রার কথা। আদিবাসীদের শিকার উৎসব। জানতেন প্রাচীন রীতি মেনে ওইদিন জঙ্গলে ঢুকে নির্বাচারে বন্যপ্রাণ হত্যা করা হয়।

সেন্দ্রার প্রচলিত রীতি নিয়ে পূরবীর অভিমত স্পষ্ট। তাঁর স্পষ্ট কথা, মানব-সমাজের যেমন বিভিন্ন অনুশাসন রয়েছে তেমনই জঙ্গলেরও নিজস্ব কিছু নিয়ম রয়েছে। অথচ সেই নিয়মের তোয়াক্কা না করে মানুষ জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। কখনও আবার ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে একদল মানুষ জঙ্গলে ঢুকে তির-বর্শা ছুড়ে শিকার করেন। পূরবীর প্রশ্ন, বন্যপ্রাণীরাও যদি কোনও দিন একজোট হয়ে প্রতিরোধ করে? এই স্পষ্ট মত থেকেই গত ২৭ মার্চ শিকার ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তবে পূরবীর দাবি, মেদিনীপুর বন বিভাগের ডিএফও রবীন্দ্রনাথ সাহার নির্দেশ ছিল, বলপ্রয়োগ না করে শিকারিদের জঙ্গলে ঢোকা ঠেকাতে হবে। কারণ, এখন ওই জঙ্গলে বাঘের উপস্থিতির খবর মিলছে। শিকারিরা বাঘের খপ্পরে পড়লে যেমন বিপদ, তেমনই শিকারিরা একসঙ্গে বাঘকে আক্রমণ করলে সিডিউল ওয়ান ভুক্ত প্রাণীটির প্রাণও যেতে পারে।

ভোর বেলা লালগড়ে সহকর্মীদের নিয়ে তৈরি ছিলেন পূরবী। আটটি ফরেস্ট রেঞ্জের ৩২ জন কর্মী ছিলেন তাঁর সঙ্গে। আর ছিল লালগড় থানার আইসি অরুণ খানের নেতৃত্বে বড়সড় পুলিশ বাহিনী। জঙ্গলে ঢোকার সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ায় আদিবাসীরা জোর করে ঢুকতে চান। পূরবীর নির্দেশে এক বিট অফিসার বিমল সরেন নিজস্ব ভাষায় আদিবাসীদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। পূরবীর কথায়, ‘‘হাজার হাজার মানুষকে আটকানো অসম্ভব ছিল। মনে জেদ চেপে গেল, আমি হারব না। এত মানুষ জঙ্গলে ঢুকলে বাঘটার ক্ষতি হবে। মানুষেরও ক্ষতি হবে।’’ তারপরই শিকারি দলের এক প্রবীণ মাতব্বরের পা আঁকড়ে ধরেন পূরবী। তিনি বলতে থাকেন, “বাবা আমি আপনার মেয়ের মতো। জঙ্গলে ঢুকতে হলে আমাকে শিকার করে তবে ঢুকুন।” পূরবী বোঝান, আধুনিক কালে এক সময়কার অনেক প্রথাই এখন যুগের প্রয়োজনে অপ্রয়োজনীয়। সেটা বোঝানোর জন্য প্রায় মিনিট কুড়ি ওই বৃদ্ধের পা আঁকড়ে ছিলেন পূরবী। শেষ পর্যন্ত ওই বৃদ্ধ পূরবীর মাথায় হাত রেখে বলেন, ‘বিটি, তুই বলছিস, তাই আমি আমার লোকেদের নিয়ে ফিরে যাচ্ছি। তবে সবার দায়িত্ব নিতে পারব না।”

কিন্তু তাতেই কাজ হয়। পূরবীর কথায়, একদল ফিরে যাওয়ায় বাকি শিকারিদের মধ্যে দোলাচল শুরু হয়ে যায়। কয়েকজন জানান, দূর থেকে অনেক টাকা গাড়ি ভাড়া করে এসেছেন। পূরবী তাঁদের পরামর্শ দেন, নদীর ধারে কিংবা পার্কে বেড়িয়ে আনন্দ করতে। সেদিন কয়েকজন যুবক জোর করে ঝিটকার জঙ্গলে ঢুকে বন শুয়োর লক্ষ্য করে বর্শা ছুড়তে শুরু করেন। তখন সার্ভিস রিভলবার বের করে রুখে দাঁড়ান পূরবী। তাতে কাজ হয়।

ঠান্ডা মাথার অফিসার হিসেবেই পরিচিত পূরবী। কতবার হাতির হানায় ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা বন আধিকারিকদের ঘিরে ধরে ক্ষোভ জানিয়েছে। কিন্তু মাথা ঠান্ডা রেখে গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। এই অভিজ্ঞতার কারণেই সিনিয়র অফিসার তাঁর ওপরে ভরসা রেখেছিলেন।

তবে ক্ষুব্ধ মানুষ ঠেকানোর থেকেও আরও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ছিল পূরবীর। ২০০৮-২০০৯ সালে চাঁদড়া রেঞ্জে বদলি হয়েছিলেন তিনি। পূরবীর কথায়, ‘‘এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের দিন কাটিয়েছি। মাওবাদী সন্ত্রাসপর্বে তখন জঙ্গলমহল জুড়ে খুন-সন্ত্রাসের দিনলিপি। সকালে যাঁর সঙ্গে কথা হল কয়েকঘণ্টা দেখলাম তিনি খুন হয়ে রাস্তায় পড়ে রয়েছেন।’’ বন্দুকের গুলি, মাইন বিস্ফোরণের আওয়াজে একটা পটকা ফাটলেও তখন বুক কেঁপে উঠত পূরবীর। মনে হতো যৌথবাহিনীর সঙ্গে মাওবাদীদের লড়াই শুরু হল।

সেসব অভিজ্ঞতাই মনোবল বাড়িয়েছে পূরবীর। বন্যপ্রাণ বাঁচানোয় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ পূরবী। মানুষ এবং বন্যপ্রাণের দ্বন্দ্ব আটকাতে তিনি সদা প্রস্তুত। বনের প্রাণীদের হয়ে সওয়াল করেন পূরবী, ‘‘লোকালয়ে হাতি কিংবা কোনও বন্যপ্রাণী ঢুকলে আমরা তাদের জঙ্গলের দিকে খেদিয়ে দিই। তাহলে মানুষ কেন জঙ্গলে ঢুকবে?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Elephants Search Light Forest Official
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE