লাইনে দাঁড়াতে হবে না। রোগী ভর্তিও হয়ে যাবে অনায়াসেই। ওষুধ কিংবা অস্ত্রোপচার নিয়েও চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। সুষ্ঠু মতোই হয়ে যাবে সব। তবে সেই সব ‘পরিষেবা’র নির্দিষ্ট ‘দর’ বাঁধা রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী সেই দর ওঠানামা করে।
‘বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস’ (বিআইএন)-এ গত ২৭ এপ্রিল অমিত মণ্ডলের মৃত্যুর ঘটনায় ফের প্রকাশ্যে এল সরকারি হাসপাতালের ‘মহার্ঘ’ পরিষেবার ছবি। এসএসকেএম কিংবা শহরের কোনও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা পরিষেবা— সব কিছুই ‘কিনে’ নিতে হয় রোগীর পরিজনেদের।
অমিতের মস্তিষ্কে জটিল অস্ত্রোপচারের জন্য স্টেন্ট, কয়েলের মতো নানা সরঞ্জাম দরকার ছিল। বাজারে যার মোট মূল্য প্রায় সাত লক্ষ টাকা। সরকারি হাসপাতালে ওই সমস্ত সরঞ্জাম বিনা মূল্যেই পাওয়া উচিত। কিন্তু অমিতের মা ঝর্নাদেবীর অভিযোগ, ওই হাসপাতালের স্টোরকিপার পলাশ দত্ত তাঁদের কাছ থেকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা ‘ঘুষ’ চেয়েছিলেন। টাকা না পেলে সরঞ্জামের আবেদনের ফাইল উপরমহলে পাঠাবেন না বলে পলাশ হুমকিও দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। ওই ফাইল হাসপাতালের অধিকর্তার কাছে পাঠানোটাই নিয়ম। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এ বিষয়ে হাসপাতালের অধিকর্তা কিংবা রোগীর তত্ত্বাবধানে থাকা চিকিৎসক কেন উদ্যোগী হননি? হাসপাতালের অধিকর্তা অজয়কুমার রায় অবশ্য এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি। পুলিশ জানিয়েছে, সোমবার পলাশকে আদালতে তোলা হলে বিচারক ১০ মে পর্যন্ত তাঁকে পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
অমিতের ঘটনায় অভিযুক্ত পলাশ গ্রেফতার হলেও সরকারি হাসপাতালের অন্দরে এমন একাধিক ‘পলাশ’ রয়েছেন বলেই ভুক্তভোগীরা জানাচ্ছেন। রোগীর পরিজনেদের একাংশের অভিযোগ, হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ পেতে হলে টাকা দিতে হয়। এসএসকেএমের চতুর্থ শ্রেণি ও চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের একাংশ এই দালাল চক্রের সঙ্গে যুক্ত বলেও অভিযোগ রোগীর পরিজনেদের। যে হেতু হাসপাতালে ভর্তির চাহিদা জোগানের তুলনায় বেশি, তাই এসএসকেএমে ‘দাম’ও সব চেয়ে বেশি। সেখানে প্রথম বার চিকিৎসককে দেখানোর আগেই হাজার তিনেক টাকা দিতে হয়। ভর্তি করিয়ে দেওয়ার পরে দিতে হয় বাকি চার হাজার। একাধিক বার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে দালাল চক্রের সঙ্গে যুক্ত হাসপাতালের চুক্তিভিত্তিক কর্মী। কিন্তু তার পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি।
এর পরে তালিকায় রয়েছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। ভর্তি হওয়ার ‘খরচ’ প্রায় দু’হাজার। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, টাকা নিয়ে পরিষেবা বিক্রির ঘটনায় সেখানে একাধিক চক্র কাজ করে। তাতে হাসপাতালের কিছু কর্মীও যুক্ত রয়েছেন। সম্প্রতি হাসপাতালের শীর্ষ কর্তারা উদ্যোগী হয়ে পুলিশের সাহায্যে দালাল চক্রে যুক্ত কর্মীদের চিহ্নিত করার পরে পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করেছে। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও ওষুধ নিয়ে এমন একাধিক চক্র চলছে। অভিযোগ, রোগীর পরিজনেদের কাছে হাসপাতালের কর্মী পরিচয় দিয়ে তাঁদের একাংশ জানিয়ে থাকেন যে, রোজ কয়েকশো টাকা দিলেই মিলবে ‘বিশেষ পরিষেবা’। এই তালিকায় ওষুধের নিয়মিত জোগান, পরিচ্ছন্ন শয্যার মতো নানা সুযোগ সুবিধা রয়েছে। টাকা দিয়ে পরিষেবা কিনতে হলে বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা নার্সিংহোমেই তো যাওয়া যায়। তা হলে সরকারি হাসপাতালে কেন টাকা দিয়ে ভর্তি হচ্ছেন? রোগীদের একাংশ জানান, যে কোনও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ কয়েক লক্ষ। কিন্তু কয়েক হাজার টাকা দিয়েই সরকারি হাসপাতালে সেই পরিষেবা মিলতে পারে।
একাধিক সরকারি হাসপাতালে বিভিন্ন সময়ে নিখরচার পরিষেবা টাকা দিয়ে কেনার যে অভিযোগ উঠেছে, তার প্রেক্ষিতে রোগীর পরিজনেরা বহুবার পুলিশের দ্বারস্থও হয়েছেন। কিন্তু এই দালাল চক্র রুখতে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে স্বাস্থ্য দফতর? স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা অবশ্য কোনও কথা বলতে চাননি। তবে স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী জানান, প্রতিটি হাসপাতালে রোগীদের যে কোনও ধরনের অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্যই কমিটি রয়েছে। এমনকি, রোগীর পরিজনেরা সরাসরি ১০৪ নম্বরে ফোন করে স্বাস্থ্য দফতরেও অভিযোগ জানাতে পারেন। স্বাস্থ্য সচিব প্রতি সোমবার বিভিন্ন অভিযোগের তদন্তের হাল দেখেন। তাঁর কথায়, ‘‘প্রায় দু’লক্ষ মানুষ স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে যুক্ত। সকলের উপরে নজরদারি চালানোর চেষ্টা চলছে। যে কোনও অভিযোগ পেলেই তদন্তে তৎপর দফতর।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy