Advertisement
০৭ মে ২০২৪
Domkal

পাট খেত অস্ত্রাগার! সিঁটিয়ে ডোমকল

ডোমকলে বোমা-আগ্নেয়াস্ত্রের এই ইতিহাস অনেক দিনের। ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটে ডোমকলে মারা যান ১৪ জন।

bombs.

ডোমকলের জিতপুরে উদ্ধার হওয়া বোমা। (ডান দিকে) সাগরপাড়ার সাহেবনগরে উদ্ধার হওয়া সকেট বোমা। ফাইল চিত্র

সুজাউদ্দিন বিশ্বাস
ডোমকল শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০২৩ ০৬:২৫
Share: Save:

ভোটের মরসুমে পাট খেত মোটামুটি এড়িয়েই চলছেন এলাকার মানুষ।

আষাঢ়ের শুরুতে বিঘার পরে বিঘা জুড়ে দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা পাট গাছ। সেই পাট খেতের মধ্যে নানা জায়গায় দশ জন করে লোকও যদি লুকিয়ে থাকে, আলপথ থেকেও বোঝা কার্যত অসম্ভব। এলাকার সীমান্ত লাগোয়া একটি গ্রামের বাসিন্দা হানিফ রহমান বলছেন, ‘‘পাটের ওই আড়ালেই বোমা বাঁধা হয়। তৈরি হয় আগ্নেয়াস্ত্র। বাইরে থেকে ভাবতেও পারবেন না।’’ আগ্নেয়াস্ত্রও? হানিফ হেসে ফেলছেন, ‘‘আগ্নেয়াস্ত্রের নানা অংশ আলাদা আলাদা করে আসে এখানে। তা জোড়া হয় স্থানীয় নানা জায়গায়। তবে আদর্শ স্থানটি হল পাট খেত।’’

চমকে উঠছেন? জেমস বন্ডের ‘ম্যান উইথ দ্য গোল্ডেন গান’ মনে পড়ে যাচ্ছে, যেখানে একটি সিগারেট কেস, একটি কলমের সঙ্গে কয়েকটি সরঞ্জাম জুড়ে বানানো হত আগ্নেয়াস্ত্র? অক্ষয় কুমারের ‘বেবি’ ছবিতেও একই ভাবে পিস্তল তৈরি দেখানো হয়েছে। সেই সব সরঞ্জাম তাঁরা বিমানে করেই নিয়ে নেপালে গিয়েছিলেন। ডোমকল যেন এই সব ঝাঁ চকচকে সিনেমার খাঁটি দেশি সংস্করণ।

এই ভাবে যে টুকরো টুকরো সরঞ্জাম এনে ডোমকলের পাট খেতগুলিতে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি হয়, তা পুলিশেরও অজানা নয়। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, ‘‘পাট খেতের জন্য ভোটের সময় জঙ্গলমহলের মতো সুবিধা পায় মুর্শিদাবাদের দুষ্কৃতীরা। পাট খেতে ড্রোন উড়িয়েও দুষ্কৃতীদের ধরা সম্ভব হয়নি।’’

আগ্নেয়াস্ত্রের এই আলাদা টুকরোগুলো আসে বাসে, টোটোয়, মোটরবাইকে। এমনকি সাইকেলেও। সীমান্তের আর একটি গ্রামের বাসিন্দা আতিকুর রহমান বলেন, ‘‘আমার সামনেই তল্লাশি করার সময় পুলিশ এক জনের ঝোলা থেকে একটা লোহার তৈরি ছোট ফাঁপা নল পেল। লোকটির দাবি, বাড়ির কাজের জন্য নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ডোমকলের লোকেরা জানেন, ওই নল দিয়ে কী হবে!’’

এ ভাবেই আসে বাঁট, স্প্রিং থেকে শুরু করে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির নানা সরঞ্জাম। সে সব জুড়ে ওস্তাদেরা বানিয়ে ফেলে নানা রকমের আগ্নেয়াস্ত্র। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, এই টুকরোগুলো আসে প্রধানত মুঙ্গের থেকে।

কী ভাবে পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়া হয়? বেআইনি অস্ত্রের এক কারবারি বলছেন, ‘‘পুলিশের কাছে নির্দিষ্ট পথের খবর পৌঁছনোর আগেই বদলে যায় সেই পথ।’’ তিনি বলেন, ‘‘ধরুন, কিছু দিন যদি সরঞ্জাম রেলপথে আসে, তার পরেই বাহন বদলে ফেলা হয়। কখনও আবার দূরপাল্লার ট্রাক বা নদীপথকেও বেছে নেওয়া হয়। তা ছাড়া, একাধিক গাড়ি ও ব্যাগ বদল করেও বিভ্রান্ত করা হয় পুলিশকে।’’

ডোমকলে বোমা-আগ্নেয়াস্ত্রের এই ইতিহাস অনেক দিনের। ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটে ডোমকলে মারা যান ১৪ জন। ডোমকলের বিধায়ক, শাসক দলের জাফিকুল ইসলামের দাবি, ‘‘তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে ডোমকলে কিন্তু তেমন সন্ত্রাস হয়নি।’’

সেখানেই উঠছে প্রতিরোধের কথা। এলাকার বাসিন্দা জার্মান মণ্ডলের বক্তব্য, ‘‘২০১৮ সালের শেষ পঞ্চায়েত ভোটে বিরোধীরা মনোনয়নই দিতে পারেনি। কিন্তু এ বার বিরোধীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। তাতেই আবার ডোমকল অশান্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।’’ সিপিএমের ডোমকল এরিয়া কমিটির সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, ‘‘তৃণমূল গণতন্ত্রের গলা টিপে মারছে। মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছেন। যদি ভোট দিতে বাধা দেওয়া হয়, একই ভাবে প্রতিরোধ করবেন মানুষ।’’ তাঁর দাবি, সেই প্রতিরোধ ভাঙতে শাসকদল বোমা-বন্দুক ব্যবহার করতে পারে। জাফিকুলের পাল্টা দাবি, ‘‘প্রতিরোধের নামে বিরোধীরাই মানুষের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে। পুলিশ-প্রশাসনের কাছে আবেদন, দল বা রং না-দেখে উদ্ধার করা হোক আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা। রক্তপাতহীন নির্বাচন চাই ডোমকলে।’’

২০০৮ সালে ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে মারা যান রেজাউল মণ্ডল। তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা বেওয়ার কথায়, ‘‘আমার যা ক্ষতি হয়েছে, তা যেন আর কারও না হয়। ভোট নিশ্চয় দেব, কিন্তু শান্তি বজায় রাখার দায় সকলেরই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Domkal WB Panchayat Election 2023
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE