Advertisement
E-Paper

চকোলেট বোমাকে পর্ষদের ছাড়পত্র

পশ্চিমবঙ্গে শব্দবাজি নিষিদ্ধ। রাজ্য সরকারের সেই ‘ঘোষিত অবস্থান’ পাল্টায়নি। কিন্তু মঙ্গলবার বিভিন্ন বাজির নমুনা পরীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ছাড়পত্র পেয়ে গেল খোদ চকোলেট বোমাই!

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:২১

পশ্চিমবঙ্গে শব্দবাজি নিষিদ্ধ। রাজ্য সরকারের সেই ‘ঘোষিত অবস্থান’ পাল্টায়নি। কিন্তু মঙ্গলবার বিভিন্ন বাজির নমুনা পরীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ছাড়পত্র পেয়ে গেল খোদ চকোলেট বোমাই! যে বাজির ‘বোমা’ খেতাবপ্রাপ্তির মধ্যেই তার শব্দের ভয়াবহতা পরিস্ফূট!'

এ দিন তারাতলা নেচার পার্ক লাগোয়া রেললাইনের ধারে ফাঁকা জায়গায় সকাল থেকে নানাবিধ বাজির নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। পুলিশ, দমকল, পর্ষদের প্রতিনিধিরা ছিলেন। ছিলেন কেন্দ্রীয় সংস্থা পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড এক্সপ্লোসিভ সেফটি অর্গানাইজেশন (পেসো)-এর লোকজনও। সঙ্গে বাজির উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা। বেলা সাড়ে এগারোটায় দশটি চকোলেট বোমা ফাটানো হয়।

পর্ষদ-সূত্রের খবর, তাদের বিজ্ঞানীর হাতে থাকা ‘সাউন্ড লেভেল মিটারে’ কোনওটার শব্দমাত্রা ধরা পড়েছে ৮৫ ডেসিবেল, কোনওটার ৮৭ ডেসিবেল। যে হেতু রাজ্যে বাজির শব্দসীমা ৯০ ডেসিবেল, তাই চকোলেট বোমা ছাড়পত্র পেয়ে গিয়েছে বলে পর্ষদের দাবি।

কিন্তু খটকাও বিস্তর।

কারণ বিশেষজ্ঞেরা বরাবর বলে আসছেন, খেলনা পিস্তলে ফাটানো ক্যাপ, কালীপটকা (একটা-একটি যদি ফাটানো হয়) কিংবা এক সময়কার ‘আলু বোমা’র মতো বাজি ছাড়া ৯০ ডেসিবেলের নীচে শব্দবাজি তৈরি কার্যত অসম্ভব। পর্ষদের কিছু বিজ্ঞানীও জানাচ্ছেন, আগে এক বারও চকোলেট বোমা পরীক্ষায় উতরোতে পারেনি। কোনওটা ১২০, কোনওটা ১৪০ ডেসিবেল আওয়াজ করে কান ফাটিয়েছে। তা হলে কোন জাদুবলে এ বার পাশ?পরিমাপের পদ্ধতি ও উপস্থিত পরীক্ষকদের ‘যোগ্যতা’র দিকে আঙুল তুলছেন পর্ষদের বিজ্ঞানীদের একাংশ। পর্ষদ-সূত্রের খবর: বাজির শব্দ মাপার জন্য কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ নির্দিষ্ট পদ্ধতি বেঁধে দিয়েছে। যেখানে বাজি ফাটবে, মাপক যন্ত্র বসাতে হবে তার পাঁচ মিটার দূরে, ও সওয়া এক-দেড় মিটার উচ্চতায়। তখন বাতাসের গতিপথ ও গতিবেগ নির্ধারণ করতে হবে। দেখতে হবে, বাজির নমুনায় যেন ভেজা ভাব না থাকে। ‘‘এত কিছু মেনে কি আদৌ পরীক্ষা হয়েছে?’’— প্রশ্ন পর্ষদেরই এক আধিকারিকের।

পাশাপাশি সংশয়, বাজির শব্দমান সঠিক ভাবে যাচাইয়ের ক্ষমতা পরীক্ষকদলের ছিল কিনা। ঘটনা হল, এ দিন পরীক্ষার সময়ে পর্ষদের প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব দিয়েছেন সিনিয়র সায়েন্টিস্ট প্রবীর বারুই, যিনি কিনা আদতে উদ্ভিদবিদ। অথচ পদার্থবিদ কিংবা মেকানিক্যাল বা কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারকে এই জাতীয় প্রক্রিয়ার পুরোভাগে রাখা দস্তুর। সে জায়গায় উদ্ভিদবিদ কেন?

প্রবীরবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমি কিছু বলব না।’’ তবে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়েছেন পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র। ‘‘তাতে কী এসে যায়? ওখানে তো পর্ষদের আরও অফিসার ছিলেন।’’— বলেন তিনি। চেয়ারম্যানের দাবি, ‘‘শব্দ মাপক যন্ত্রের রেকর্ড অনুযায়ীই যাবতীয় নমুনা ছাড়পত্র পেয়েছে।’’

বাজি উৎপাদক ও বিক্রেতারা যারপরনাই উল্লসিত। খাতায়-কলমে নিষিদ্ধ হলেও রাজ্যে এত দিন অবৈধ ভাবে যত শব্দবাজি তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় চকোলেট বোমা। দামে সস্তা, আওয়াজ বেশি। বানানোও সহজ হওয়ায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব বয়সের কারিগরের আয়ত্তে। এ বার হঠাৎ চকোলেটের ‘গলার জোর’ কমে গেল?

সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান বাবলা রায়ের ব্যাখ্যা— চকোলেট বোমার ভিতরে কাগজের বাক্সে মশলা ঠাসা হয়। কাগজ যত পুরু, আওয়াজ তত বেশি। ‘‘আগে পাঁচ-ছ’মিলিমিটার মোটা কাগজ দেওয়া হতো। বহু ভাবনা-চিন্তা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ বার তিন-চার মিলিমিটার রাখা হয়েছে। এতেই আওয়াজ ৯০ ডেসিবেলের নীচে আটকে গিয়েছে।’’— বলছেন বাবলাবাবু। দোদমাও পরীক্ষায় পাশ করেছে বলে ওঁদের দাবি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার চম্পাহাটির এক বাজি কারখানার মালিক নিমাইচন্দ্র মণ্ডলের পর্যবেক্ষণ, ‘‘দোদমার আকার ও মশলার পরিমাণ কমানো হয়েছে। তাই উতরে গিয়েছে।’’ সমিতির বক্তব্য, একশো টন চকোলেট বোমা ইতিমধ্যে তৈরি। সেগুলোর কাগজ তিন-চার মিলিমিটারের বেশি পুরু নয়। অর্থাৎ, আওয়াজ বাঁধা থাকবে ৯০ ডেসিবেলের মধ্যে।

যদিও পর্ষদের বিজ্ঞানীরা বিশেষ ভরসা পাচ্ছেন না। ওঁদের সাফ কথা, শব্দ ৯০ ডেসিবেলের কম হলে বুঝতে হবে, তা অন্য বাজি। চকোলেট বা দোদমা নয়। এ ক্ষেত্রে বাজিগুলোর অন্য নাম থাকা উচিত। ‘‘ধরে নিলাম, তারাতলায় ৯০ ডেসিবেলের কম শব্দের পটকা চকোলেট বোমা নাম দিয়ে ফাটানো হয়েছে। কী গ্যারান্টি যে, সব চকোলেট নব্বই ডেসিবেলের কমে ফাটবে? কার কাগজ চার মিলিমিটার পুরু, কারটা ছ’মিলিমিটার, কে দেখবে’’— প্রশ্ন এক বিজ্ঞানীর।

এমতাবস্থায় ওঁদের ধারণা, সামনের ক’দিন ১২০ ডেসিবেলের বোমাও ফাটবে। প্রমাদ গুনছে পরিবেশ মহলও। ‘‘দেওয়ালি আলোর উৎসব। যার উদ্দেশ্যই শব্দ সৃষ্টি, সেই বাজি কী ভাবে ছাড়পত্র পেল মাথায় ঢুকছে না।’’— আক্ষেপ করছেন পরিবেশকর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়।

আক্ষেপটা তামাম রাজ্যবাসীর মুখে মুখে ফেরে কিনা, সেটাই দেখার।

West Bengal pollution control board Clearance Sound crackers
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy