সমাবেশ মঞ্চের পথে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা ত্বহা সিদ্দিকি। শুক্রবার দীপঙ্কর দে-র তোলা ছবি।
এক জনের লক্ষ্য ছিল বিধানসভা ভোটের আগে সংখ্যালঘু মানুষের ‘বন্ধু’ হিসাবে নিজেকে আরও প্রতিষ্ঠা করা। অন্য জনের লক্ষ্য, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রভাব ও ক্ষমতার কথা সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। একই মঞ্চ থেকে আলাদা আলাদা ভাবে কৌশলে দুই লক্ষ্য পূরণ করে নিলেন দু’জনেই!
প্রথম জন— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধানসভা ভোট যত কাছাকাছি আসছে, সংখ্যালঘুদের কাছে টানার চেষ্টায় গতি বাড়াচ্ছেন তিনি। তারই অঙ্গ হিসাবে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর সমাবেশের পরে শুক্রবার ‘সংখ্যালঘু দিবসে’ ফুরফুরা শরিফে ত্বহা সিদ্দিকির সভায় হাজির হলেন মুখ্যমন্ত্রী। এবং ফুরফুরার মঞ্চ থেকে সংখ্যালঘুদের মন পেতে জোড়া কৌশল নিতে দেখা গেল তাঁকে। প্রথমত, রাজ্যে তৃণমূলের সরকারই সংখ্যালঘুদের প্রকৃত উন্নয়নে কাজ করেছে, এই বার্তা দিতে দীর্ঘ বিবরণ শোনালেন। রাজ্যের রাজস্ব থেকে কেন্দ্রীয় সরকার ৯০% টাকা কেটে নিয়ে চলে গেলেও উন্নয়নের গতি তিনি থামতে দেননি, দাবি করলেন মুখ্যমন্ত্রী। আর দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রে বিজেপি-র সরকার ক্ষমতায় আসার পরে তাদের নানা কাজকর্মে সংখ্যালঘুদের বড় অংশের মধ্যে যে ‘আশঙ্কা’ তৈরি হয়েছে, তা সামনে এনে নিরাপত্তার আশ্বাস দিলেন নিজেই। আমির ও শাহরুখ খানের নাম টেনে অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে বার্তা দিয়ে বললেন, ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন এ রাজ্যে চলবে না।
দ্বিতীয় জন— ত্বহা সিদ্দিকি। রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে ফুরফুরার পীরের প্রভাব কতটা, মুখ্যমন্ত্রীর মঞ্চ ছাড়া তা দেখানোর উপযুক্ত জায়গা আর কী ছিল? সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন তিনি! তাঁরা চাইলে রাজ্যের ৪৮টি বিধানসভা আসন জিতে দেখিয়ে দিতে পারেন, সরাসরি হুঙ্কার দিয়ে রাখলেন! তাঁদের দাবি-দাওয়া উপেক্ষার ফল ভাল হবে না বোঝাতে এমনও বললেন, ‘‘তৃণমূল, বামফ্রন্ট বা কংগ্রেস প্রার্থী তালিকা ঘোষণার ১৫-২০ দিনের ভিতরে কলকাতায় গিয়ে ফাইনাল খেলা খেলে আসতে পারি!’’ তবে এ সবই হল মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চে আসার আগে! মমতাকে মঞ্চে পেয়ে ত্বহা বললেন, ‘‘রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কিছুটা যোগাযোগ আছে। সেই সুবাদেই আমাকে সাধারণ মানুষ তাঁদের দাবিদাওয়ার কথা বলেন। আমি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সেগুলো পৌঁছে দিই। আমার বিশ্বাস, মুখ্যমন্ত্রী সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের প্রয়োজনীতার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাববেন।’’ ত্বহার এই কৌশলে যাকে বলে, সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না!
তৃণমূলেরই এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘সিদ্দিকুল্লার সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী যাওয়ায় ত্বহা সিদ্দিকিদের একটা বাড়তি তাগিদ ছিল। সিদ্দিকুল্লা সে দিন অপ্রিয় কোনও কথাই বলেননি। ত্বহা মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চে আসার আগেই তাঁর অনুগামীদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, সংখ্যালঘুদের কণ্ঠস্বর হিসাবে তিনি লড়ছেন।’’ মুখ্যমন্ত্রীর হাতে এ দিনও ২৫ দফা দাবিপত্র তুলে দিয়েছেন ত্বহা। তাঁর ডাকে ‘মুজাদ্দেদিয়া অনাথ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত ওই সমাবেশে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ছিলেন।
রেলমন্ত্রী মমতার আমলে ঘোষিত রেল-প্রকল্প সম্পূর্ণ না হওয়ায় ফুরফুরার মানুষের ভাবাবেগ দীর্ঘ দিনের। তা মাথায় রেখেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা মনে করাতে ভোলেননি যে, ফুরফুরায় তাঁর উদ্যোগেই রেললাইনের কাজ শুরু হয়েছিল। ফুরফুরার সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি একটি কমিটি গড়ে দিয়েছেন। সেই কমিটির মাধ্যমে ইতিমধ্যেই ৭৫ কোটি টাকার কাজ চলছে। এলাকার সড়ক উন্নয়নেও তিনি যে ‘দরদি’, সংখ্যালঘুদের প্রশ্নের উত্তরে সে কথাও তিনি বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন। বলেছেন, ‘‘উন্নয়নের কাজ আমরা করছি। বামফ্রন্ট আমলে সংখ্যালঘু দফতরের বাজেট ছিল ৪০০ কোটি টাকা। আমাদের সরকার সেটা প্রায় ২৪০০ কোটি টাকা করেছে।’’
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার আগে ত্বহা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, ভোটে তাঁরা কত বড় নির্ণায়ক শক্তি। তাঁর কথায়, ‘‘এই সমাবেশ তৃণমূল, ফ্রন্ট বা কংগ্রেস কারও বিরুদ্ধে নয়। আমরা যদি চাই, রাজ্যের ৪৮টা আসন এই ত্বহা জিতিয়ে দিতে পারে! রাজনীতির চ্যালেঞ্জ করবেন না। কাজ করুন!’’
জেলায় এলে ইদানীং সিঙ্গুরের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান মমতা। ব্যতিক্রম ছিল এ দিন। তাপসী মালিককে এই দিনেই খুন করা হয়েছিল উল্লেখ করে মমতার মন্তব্য, ‘‘সিঙ্গুরের দিনগুলি মনে রাখবেন। আমি চিরকাল মনে রাখব! সিঙ্গুরে দাঁড়িয়ে এক সময় নমাজ পড়েছিলাম। ইফতারও সেরেছিলাম।’’ ফুরফুরায় আসার আগে ডানকুনিতে প্রশাসনিক সভা করেন মমতা। সেখানে ৮টি নতুন সরকারি বাসরুটের সূচনা এবং পাঁচটি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। শিলান্যাস করেন ২৬টি প্রকল্পেরও। যার প্রায় অধিকাংশই জাঙ্গিপাড়া এবং ফুরফুরা-কেন্দ্রিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy