মিতা মণ্ডল
বছর চব্বিশের যুবতীটিকে যখন হাসপাতালে আনা হয়েছিল, তখন দেহে আর সাড় নেই। মুখ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। কপাল ফুলে উঠেছে জোরালো আঘাতে।
মিতা মণ্ডল নামে ওই যুবতীর দেহ পরীক্ষা করে হাওড়ার ফুলেশ্বরের বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সন্দেহ হয়েছিল। যুবতীর স্বামী রানা মণ্ডল আবার তাঁদের হাসপাতালেরই কর্মী। কী করে স্ত্রীর এই অবস্থা হল, তা নিয়ে রানার কথাবার্তায় সন্দেহ আরও বাড়ে চিকিৎসকদের। তাঁদের দেওয়া খবরের ভিত্তিতে উলুবেড়িয়া থানার পুলিশ এসে আটক করে মিতার দেহ। পরে গ্রেফতার করা হয় তাঁর স্বামী রানা ও শ্বশুর বিজেন্দ্র মণ্ডলকে। অভিযোগ দায়ের হয়েছে শাশুড়ি ও দেওরের বিরুদ্ধেও। তাঁরা পলাতক বলে জানিয়েছে পুলিশ।
দশমীর ভোরে মেধাবী মেয়ের এই মৃত্যুর খবর আসার পর বিসর্জনের বিষাদ ছেয়ে যায় সোনারপুরে, তাঁর বাপের বাড়িতে। অভাবের সংসারে অনেক কষ্টে মিতাকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছিলেন বাবা সহদেব দাস। বাংলায় প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাশ করেছিলেন মিতা। মাস ছয়েক আগে প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ টাকা খরচ করে বিয়েও দেন বাবা।
সোনারপুরের গড়িয়া শান্তিনগরের বাসিন্দা সহদেববাবু পেশায় রাজমিস্ত্রি। বছরখানেক ধরে শারীরিক কারণে শয্যাশায়ী। দুই দাদা বাপ্পা ও খোকনের ছোটখাটো ব্যবসা। বছর দুয়েক আগে একটি বিয়েবাড়িতে উলুবেড়িয়ার কুশবেড়িয়ার বাসিন্দা রানার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল মিতার। পরে দুই পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ করে বিয়ে ঠিক হয়। উচ্চ মাধ্যমিক পাস রানা ফুলেশ্বরের বেসরকারি হাসপাতালের ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান। মঙ্গলবার ভোরে ওই হাসপাতালেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মিতাকে।
খোকনবাবু জানান, মঙ্গলবার, দশমীর ভোর ৫টা নাগাদ বোনের শ্বশুরবাড়ি থেকে ফোন আসে। বলা হয়, মিতা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাসপাতালে। খোকনবাবুর অভিযোগ, তাঁদের বাড়ির লোকেরা হাজির হলে মোটরবাইক নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যান
রানা ও তাঁর বাবা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, হাসপাতালে আনার আগেই মারা গিয়েছিলেন মিতা। তাঁর শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে খবর দেওয়া হয় পুলিশকে। খোকনবাবু জানান, তাঁরাও হাসপাতালে এসে দেখেন, মিতার নাক থেকে রক্ত পড়ছে। কপাল ফুলে উঠেছে। তাঁদের অভিযোগ, পিটিয়ে খুন করা
হয়েছে মিতাকে।
অভিযুক্তদের পরিবারের অবশ্য দাবি, আত্মঘাতী হয়েছেন মিতা। পুজো দেখাতে নিয়ে যাওয়া নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গোলমাল হয়েছিল। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে শেষরাতে বাড়ি ফেরেন রানা। সে সময়ে ঘরের দরজায় ভিতর থেকে খিল তোলা ছিল। পুলিশকে রানা জানিয়েছেন, দরজা ধাক্কা দিয়ে সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি জানলার ফাঁক দিয়ে দেখেন, সিলিং ফ্যান থেকে গলায় দড়ির ফাঁস লাগিয়ে ঝুলছেন স্ত্রী। দরজা ভেঙে তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান রানা। তাঁর দাবি, দড়ি কেটে নামাতে গিয়েই খাটে ধাক্কা লেগে নাক ও কপালে চোট লাগে মিতার। তাতেই রক্ত বেরোয়। যদিও এই প্রসঙ্গে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন যে, রানার দাবির মধ্যে অনেক ফাঁক রয়েছে। সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
মিতার পরিবার সূত্রের খবর, মাস দেড়েক আগে সোনারপুরে এসে বাবার কাছে এক লক্ষ টাকা চেয়েছিলেন মিতা। টাকা দিতে পারেননি বাবা। মুখ নিচু করে ফিরে গিয়েছিলেন মেয়ে। খোকনবাবু বলেন, ‘‘চতুর্থীর দিন বাড়ি এসেছিল বোন। সপ্তমীর দিন জামাই এসে নিয়ে যায়। সে সময়ে বোন জানিয়েছিল, জামাই খুব মদ খায়। আর কিছু খুলে বলেনি।’’ খোকনবাবুর দাবি, ওই সময়েও বোনের মাথায় ও কপালে ফোলা দাগ ছিল। কী করে ওই দাগ হল, তা জানতে চাইলে এড়িয়ে গিয়েছিল। খোকনবাবু বলেন, ‘‘কী করে বোনকে মারা হল, তা তদন্ত করে দেখুক পুলিশ।’’
মঙ্গলবার উলুবেড়িয়া থানা প্রথমে অভিযোগ নিতে টালবাহানা করছিল বলে মৃতার পরিবারের দাবি। হাওড়া (গ্রামীণ) পুলিশের এক কর্তা অবশ্য জানান, খুনের অভিযোগ নিতে গেলে কিছু প্রক্রিয়াগত ব্যাপার থাকে। সে জন্য হয় তো কিছুটা দেরি হয়ে থাকতে পারে। তবে অভিযোগ পাওয়ার পরেই গ্রেফতার হয়েছে দু’জন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy