চলছে মহড়া। বহরমপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।
স্কুলে ঢুকতেই দেখা গেল, একদল কচিকাঁচা স্কুল চত্বরেই রীতিমতো কসরত করে চলেছে। একটু ঠাহর করলে বোঝা যায়, তারা শিখে নিচ্ছে কী ভাবে মঞ্চে আলো নিতে হয়, কী ভাবেই বা সংলাপে ফুটিয়ে তোলা যায় চরিত্র। আর এই সব নাটকীয় মহড়ার তত্ত্বাবধানে রয়েছে বহরমপুরের ‘গাঙচিল’ নাট্যদল। বহরমপুর ও সংলগ্ন এলাকার মোট ৮টি স্কুলে চলছে নাটকের ওয়ার্কশপ। নিয়মিত মঞ্চস্থ হচ্ছে ছোটদের নিয়ে নাটক।
বহরমপুর শহর থেকে ট্রেকারে চেপে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে ভজরামপুর গ্রামে যাওয়া গেল। মূলত নিম্নবিত্ত পরিবারের বাস গ্রামে। সেখানেই রয়েছে মোনার্ক স্কুল অফ হিউম্যান এক্সিলেন্স। স্কুল চত্বরে গিয়ে দেখা গেল, তারিন, নূরজাহান, বাপ্পা, অনুসূর্যরা শিখে নিচ্ছে অভিনয়ের প্রথম পাঠ। রয়েছে মুখোশ তৈরি, মুখাভিনয়, মেক আপের মতো মঞ্চের পিছনের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও। দিন কয়েক আগেই তারা মঞ্চস্থ করে ‘হ্যাপি প্রিন্স’। জীবিত অবস্থায় রাজসিক জীবনে অভ্যস্ত রাজপুত্র মৃত্যুর পর লক্ষ্য করে সাধারণ মানুষের দুঃখময় জীবন। গল্পের রাজপুত্র আর দোয়েল পাখির সম্পর্কটি সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে এখানের পড়ুয়ারা। রাজপুত্রের চরিত্রে নূরজাহান ও দোয়েলের ভূমিকায় বাপ্পার অভিনয় প্রশংসার দাবি রাখে। নাটকের দর্শক মাত্রই লক্ষ্য করতে পারেন, অস্কার ওয়াইল্ডের এই গল্প বাংলার রঙ্গমঞ্চে বারবার ফিরে এসেছে। বছর খানেক আগে চেতলা কৃষ্টি সাংসদের শিশু নাট্যোৎসবে শান্তিপুর সাজঘরের প্রযোজনায় এই গল্পটিই নাট্যরূপ পেয়েছিল। স্কুলের অধ্যক্ষ বনমালি মণ্ডলও পুরো উদ্যোগ নিয়ে যেথেষ্ট উৎসাহী। তাঁর কথায়, ‘‘এই কর্মশালার জন্যই আমাদের প্রত্যন্ত গ্রাম নাটকের মূল ধারার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছে।’’
শহরের বাংলা মাধ্যম স্কুল শ্রীগুরু পাঠশালা, অগ্রগতি শিশু শিক্ষা নিকেতন, শিল্প মন্দির গার্লস হাইস্কুল-সহ মোট ৮টি স্কুলে এ ভাবেই গাঙচিলের তত্ত্বাবধানে কর্মশালা চলছে। সামিল হয়েছে প্রায় ১৫০ জন পড়ুয়া। দর্শকের প্রশংসা কুড়িয়েছে ‘সবুজের সন্ধানে’, ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’ বা সৌমিত্র বসুর লেখা ‘মুড়কির হাড়ি’র মতো বিভিন্ন প্রযোজনাগুলি। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘শুভা’কেও মঞ্চে এনেছে গাঙচিল। কর্মশালায় গাঙচিলের সদস্যদের সঙ্গে সামিল আর্ট কলেজের প্রাক্তনী মৃগাঙ্ক মণ্ডল, কোচবিহারের দেবব্রত আচার্য বা শান্তিপুরের সুলেমান আলিও। নাটকে বিভিন্ন যন্ত্রানুষঙ্গের প্রয়োগ সম্পর্কে পড়ুয়াদের পাঠ দিতে আসেন অল ইন্ডিয়া রেডিও-র ব্রতজিৎ ঘোষ। মুখাভিনয়ের প্রশিক্ষণে সুব্রত ঘোষ।
তবে ছোটদের মঞ্চে আনার কাজটা শুরুতে ঠিক কেমন ছিল? গাঙচিলের তরফে রাহুল ঘোষ, তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়রা বলেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে অভিভাবক ও স্কুলগুলি আমাদের কর্মশালা কতটা সফল হবে সে বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন। তবে পরে তাঁরাই এগিয়ে এসে আমাদের সাহায্য করেছেন।’’ বাংলার মঞ্চে এখন ছোটদের খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন বলেই মত নাটকের দর্শকদের। বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব অর্পিতা ঘোষও বলেন, ‘‘সময়ের অভাব, পড়াশোনার চাপ এখনকার ছোটদের প্রধান সমস্যা। এই পরিস্থিতিতে ছোটদের মঞ্চে পাওয়াটা নির্দেশকদের কাছে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’ কঠিন জেনেও কেন ছোটদের নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা নেওয়া হল? উত্তরে রাহুলবাবু বলেন, ‘‘১৯৯১ সালে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার তরফে একটি কর্মশালা হয়। সেখানে থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই এমন পরিকল্পনা নেওয়া।’’ তবে কর্মশালা চালাতে গিয়ে প্রধান অসুবিধা অর্থের। মহড়ার স্থায়ী জায়গারও অভাব আছে।
এ সব প্রতিবন্ধকতা সামলেই ২৩ অগস্ট থেকে গোরাবাজারের ঈশ্বরচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে শুরু হয়েছে নতুন কর্মশালা। রক্তিম, ভাস্কর, তনভিরদের মতো প্রায় ৫০ জন পড়ুয়ারা যোগ দিয়েছে এখানে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক জয়ন্ত দত্ত একটি ঘর কর্মশালার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। জয়ন্তবাবু বলেন, ‘‘নাটকের মঞ্চ পড়ুয়াদের জন্য এক সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’ পরের ডিসেম্বর মাসে আয়োজন করা হবে নাট্য উৎসবও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy