Advertisement
০৫ মে ২০২৪

বিয়ে করবে না, পড়তে চেয়ে বাড়িই ছাড়ল যমুনা

রেখা কালিন্দী, বীণা কালিন্দী, আফসানা খাতুনদের হাত ধরে যে আন্দোলনের শুরু, তা আজও ফিকে হয়ে যায়নি পুরুলিয়ায়! রেখা, বীণাদের দেখানো পথেই পড়তে চেয়ে নিজের বিয়ে রুখে দিল পুরুলিয়ার পুঞ্চা থানার এক প্রত্যন্ত গ্রামের নাবালিকা স্কুলছাত্রী। এবং তা করল এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশ্রয়ে থেকে শিক্ষাকেই হাতিয়ার করে। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীটির বিয়ে ঠিক করেছিল পরিবার। সে কিন্তু বলে দিয়েছিল, বিয়ে করবে না। পড়বে। তা নিয়ে পরিবারে টানাপড়েন চলছিল।

যে স্কুলে আশ্রয়, তারই পড়ুয়াদের পড়া বোঝাচ্ছে যমুনা। — নিজস্ব চিত্র।

যে স্কুলে আশ্রয়, তারই পড়ুয়াদের পড়া বোঝাচ্ছে যমুনা। — নিজস্ব চিত্র।

সমীর দত্ত
পুঞ্চা শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৫ ০৪:১৪
Share: Save:

রেখা কালিন্দী, বীণা কালিন্দী, আফসানা খাতুনদের হাত ধরে যে আন্দোলনের শুরু, তা আজও ফিকে হয়ে যায়নি পুরুলিয়ায়!

রেখা, বীণাদের দেখানো পথেই পড়তে চেয়ে নিজের বিয়ে রুখে দিল পুরুলিয়ার পুঞ্চা থানার এক প্রত্যন্ত গ্রামের নাবালিকা স্কুলছাত্রী। এবং তা করল এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশ্রয়ে থেকে শিক্ষাকেই হাতিয়ার করে। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীটির বিয়ে ঠিক করেছিল পরিবার। সে কিন্তু বলে দিয়েছিল, বিয়ে করবে না। পড়বে। তা নিয়ে পরিবারে টানাপড়েন চলছিল। শুনতে হয়েছিল অনেকের বক্রোক্তিও, ‘পুঁচকে মেয়ে বলে কী! এত সাহস!’ তেরো বছরের যমুনা মুদি কিন্তু অন্য রকম ভেবেছিল। এক দিন স্কুলে গিয়ে সে আর বাড়ি ফিরল না। শুধু তাই নয়, ফোন করে পাত্রপক্ষকেও জানিয়ে দিল, এখন বিয়ে করবে না। যমুনা তার নিজের স্কুল লগোয়া শিশুদের এক আবাসিক স্কুলে আপাতত আশ্রয় নিয়েছে।

পুঞ্চার মুদিডি গ্রামের দিনমজুর ভীষ্ম মুদির দুই মেয়ে, এক ছেলে। দু’সপ্তাহ আগে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ইচ্ছে ছিল দুই বোনের এক সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হবেন। কিন্তু ছোট জন যমুনার জেদের কাছে তাঁকে হার মানতে হল। ভীষ্মবাবুর কথায়, ‘‘আমাদের সমাজে মেয়েকে বেশি বয়সে বিয়ে দিলে নিন্দা জোটে। তাই বিয়ের বয়স না হওয়া সত্ত্বেও যমুনার সম্বন্ধ ঠিক করেছিলাম এলাকার এক গ্রামে। যমুনা কিন্তু বারবার বলেছিল, ও বিয়ে করতে চায় না। আরও পড়তে চায়। ওর কথা শুনে পরে বুঝতে পেরেছি, আমি ভুল করতে যাচ্ছিলাম। তাই ওর ইচ্ছেকেই সম্মান জানালাম। ওর জামা-কাপড়ও স্কুলে দিয়ে এসেছি।’’ যমুনার মা প্রতিমাদেবী বলেন, ‘‘কম বয়সে বিয়ে দেওয়া ঠিক নয় আমরাও জানি। কিন্তু, নানা জনের চাপ ছিল। গ্রামে বাস করে সবাইকে চটানো যায় না।’’

পুঞ্চা ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ঠিক পিছনেই পুঞ্চা মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র। সেখানেই এ বছর সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে পড়ে যমুনা। ওই কেন্দ্রের পাশে রয়েছে ‘নবদিশা’ নামে শবর শিশুদের একটি অবৈতনিক আবাসিক স্কুল। সংগৃহীত দানে বছর চারেক হল স্কুল চলছে। কিছুদিন হল যমুনা আবাসিক স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে। এই স্কুলটি চালান পুঞ্চার বাসিন্দা, কলকাতা পুলিশের কর্মী অরূপ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘স্কুলের কর্মী আমাকে ফোনে সব জানিয়ে ওই মেয়েটি এখানে আশ্রয় চায় বলেছিল। পরে যমুনার বাবাও স্কুলে এসে তাঁর মেয়েকে এখানে রেখে দেওয়ার আর্জি জানান। সেই থেকে ও এখানেই আছে। এখানে থেকেই ও নিজের স্কুলে যাবে।’’ যমুনার স্কুলের প্রধান শিক্ষক শচীন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যমুনার বাবাকে আমিও বুঝিয়েছি, এত কম বয়সে বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। তা ছাড়া মেয়েটা লেখাপড়ায় ভাল।’’

বুধবার দুপুরে ওই আবাসিক স্কুলে গিয়ে দেখা গেল, খুদে পড়ুয়াদের পড়া দেখাতে ব্যস্ত যমুনা। দ্বিতীয় শ্রেণির কল্যাণ শবর, তৃতীয় শ্রেণির সন্ধ্যা শবর বলে, ‘‘কোনও পড়া বুঝতে না পারলে পরে যমুনা দিদিই বুঝিয়ে দিচ্ছে।’’ কিন্তু, এখানে আশ্রয় নেওয়ার ভাবনা এল কোত্থেকে? যমুনার কথায়, ‘‘এই আবাসিক স্কুলের কয়েক জন মেয়েও মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রে পড়ে। তারা আমাকে সাহস জুগিয়েছিল। তা ছাড়া কম বয়সে বিয়ে করে এখনই সংসার করতে চাই না। তাই ছেলের বাড়ির ফোন নম্বর জোগাড় করে বিয়ে করব না বলে জানিয়ে দিয়েছি।’’ পুঞ্চার বিডিও সুপ্রতীক সিংহ বলেন, ‘‘মেয়েটির প্রতিবাদ প্রশংসনীয়। প্রশাসন ওর পাশে আছে।’’

ভীষ্মবাবু জানাচ্ছেন, আপাতত মেয়ে ওখানেই থাকুক। পরে বাড়িতে আসতে চাইলে নিয়ে আসবেন। আর বিয়ে? জিভ কেটে বললেন, ‘‘আবার বিয়ের কথা! আগে মেয়ে পড়াশোনা করে সাবালিকা হোক। তখন নিজের ভালমন্দ নিজেই বুঝতে পারবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Yumana marriage school student abpnewsletters
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE