কড়া দাওয়াই দিলে শৃঙ্খলা যে ফিরিয়ে আনা যায় বৃহস্পতিবার তা দেখল কলকাতা হাইকোর্ট। আইনজীবীরা কর্মবিরতি পালনের ডাক দিলেও, বিচারপতিদের অনমনীয় মনোভাবে এ দিন সচল ছিল হাইকোর্ট। নিজেদের সংগঠনের ডাকা কর্মবিরতির আন্দোলন ছেড়ে আইনজীবীদের একাংশ দাঁড়িয়েছিলেন হাইকোর্ট-কর্তৃপক্ষের পাশেই।
এক আইনজীবীর মৃত্যুতে বৃহস্পতিবার কলকাতা হাইকোর্টে পূর্ণ দিবস (সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টে পর্যন্ত) কর্মবিরতির ডাক দেওয়া হয়। বুধবারই এই কর্মবিরতির ডাকের প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি এবং অন্য বিচারপতিরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, তাঁরা এজলাসে বসবেন। সেই মতো এ দিন সকালে নির্দিষ্ট সময়েই সব বিচারপতি তাঁদের এজলাসে বসেন। আইনজীবীদের একটা বড় অংশ আদালত বয়কট করেন। কিন্তু দেখা যায় এক দল আইনজীবী নিজেদের মামলা নিয়ে নির্দিষ্ট এজলাসে হাজির হয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক আইনজীবীই এ দিন কর্মবিরতির আন্দোলন ধাক্কা খাওয়ায় খুশি। এক আইনজীবী বলেন, “আগের প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র কোনও আইনজীবীদের মৃত্যুতে হঠাৎ হঠাৎ কর্মবিরতির আন্দোলন প্রত্যাহার করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সফল হননি। বর্তমান প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর দায়িত্ব নিয়েই কড়া হাতে পরিস্থিতি সামলেছেন। আমরা শৃঙ্খলা রক্ষার এই দাওয়াইয়ে খুশি। এতে মানুষের আস্থা আরও বাড়বে।”
দায়িত্ব নিয়ে নতুন প্রধান বিচারপতি কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রয়েছে বছরে কমপক্ষে ২১০ দিন হাইকোর্ট চালু রাখতে হবে। কী ভাবে হাইকোর্ট কমপক্ষে ২১০ দিন চালু রাখা যায় তার ব্যবস্থা করতে প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর চার সদস্যের একটি কমিটি গড়ে দিয়েছেন। ওই কমিটিতে রয়েছেন বিচারপতি প্রণব চট্টোপাধ্যায়, বিচারপতি শুভ্রকমল মুখোপাধ্যায়, বিচারপতি নিশীথা মাত্রে এবং বিচারপতি ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায়।
হাইকোর্টের আইনজীবীদের সংগঠনগুলির কাছে ওই কমিটি সম্প্রতি একটি প্রস্তাবও পাঠিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ঘোষিত ছুটি ছাড়া অন্য কোনও কারণে হাইকোর্ট পূর্ণ দিবস বন্ধ রাখা হলে শনিবার (হাইকোর্ট শনি ও রবি পূর্ণ দিবস বন্ধ থাকে) কাজ করে তা পুষিয়ে দিতে হবে। নয়তো বেলা চারটের পরে শোকপালন করতে হবে। কিন্তু কোনও অবস্থায় পূর্ণ বা অর্ধদিবস হাইকোর্ট বন্ধ রাখা যাবে না। কারণ, আদালত বন্ধ থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হন বিচারপ্রার্থীরাই। মক্কেলদের স্বার্থেই আইনজীবীদের হাইকোর্ট চালু রাখা উচিত বলে মনে করেন কমিটির সদস্যেরা।
সুপ্রিম কোর্টে এ সব ঘটনায় কী হয়? আইনজীবীদের একাংশ জানান, সুপ্রিম কোর্টের কোনও আইনজীবীর মৃত্যু হলে কাজ শুরুর প্রথম পনেরো মিনিট শোকজ্ঞাপনের জন্য নির্দিষ্ট থাকে। তার পরে স্বাভাবিক ভাবে কাজ শুরু হয়ে যায়।
কলকাতা হাইকোর্টের নিয়ম কী?
আইনজীবীদের একাংশ জানান, কলকাতা হাইকোর্টের কোনও আইনজীবীর মৃত্যু হলে এক এক ক্ষেত্রে এক এক নিয়ম মানা হয়। কারও ক্ষেত্রে সকাল সাড়ে ১০টায়, কারও ক্ষেত্রে বেলা সাড়ে ৩টে, আবার কারও ক্ষেত্রে বেলা ২টোর পরে হাইকোর্টে কর্মবিরতি পালনের ডাক দেওয়া হয়। ওই আইনজীবীদের দাবি, কোনও ক্ষেত্রে সকাল সাড়ে ১০টা, কোনও ক্ষেত্রে বেলা ২টো, কোনও ক্ষেত্রে বেলা সাড়ে ৩টে, এটা কারা ঠিক করছেন, তা অনেকেই জানেন না। এই ব্যবস্থা বন্ধ করে প্রয়োজন হলে সকলের জন্যই এক নিয়ম চালুর দাবি তুলেছেন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীদের একাংশ। তাঁরা বিচারপতিদের কমিটির সিদ্ধান্তকেও স্বাগত জানিয়েছেন।
আইনজীবীদের একটা বড় অংশ ফের কর্মবিরতির ডাক দেওয়ায় বৃহস্পতিবার কলকাতা হাইকোর্টে স্বাভাবিক কাজকর্ম হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু এ দিন হাইকোর্টে একটি ভিন্ন দৃশ্য দেখা গেল। যাঁরা এ রকম ভাবে হুটহাট কর্মবিরতির বিপক্ষে তাঁদের বিভিন্ন এজলাসে মামলা লড়তে দেখা গিয়েছে।
কর্মবিরতির আন্দোলন ভেঙে এ দিন কলকাতা হাইকোর্টে কাজ হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আইনজ্ঞদের অনেকেই। বম্বে হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “এমনিতেই মামলার পাহাড় জমে রয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। তার উপরে এই ভাবে কর্মবিরতি হলে বিচারপ্রার্থীরাই বিপদে পড়ছেন। কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে। কিন্তু কর্মবিরতি পালনের ঘন ঘন প্রস্তাব নেওয়া হলে কাজটা ঠিক হচ্ছে না।”
সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় এবং কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিচারপতি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একমত। অশোকবাবু বলেন, “আইনজীবীরা যা করছেন, তা এক কথায় জনবিরোধী। কোনও ভাবেই একে সমর্থন করি না।” আর ভগবতীবাবুর মন্তব্য, “শোকজ্ঞাপন খারাপ কিছু নয়। তবে সপ্তাহের শেষ কাজের দিন শুক্রবার অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করা যেতে পারে।”
কর্মবিরতির আন্দোলনের মধ্যেও এই ভাবে হাইকোর্টে কাজ হওয়ায় আন্দোলনের সমর্থকেরা প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাইছেন না। কলকাতা হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক রানা মুখোপাধ্যায় বলেন, “মায়ের অসুস্থতার কারণে তিন দিন হাইকোর্টে যাচ্ছি না। তাই বৃহস্পতিবার কী হয়েছে বলতে পারব না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy