Advertisement
E-Paper

অসাড় শরীর জয় করেই এভারেস্ট বেসক্যাম্পে

ডায়েরির পাতায় প্রতি দিন একটাই লাইন লিখতেন ‘আর কোনও দিন হিমালয়ে যেতে পারব না।’ নীচে কাঁপা হাতে সই। ঘনিষ্ঠরা ভেবেছিলেন, এ ভাবে চললে হয়তো পাগলই হয়ে যাবেন নিশিকান্ত সেন। আচমকা স্ট্রোকে তাঁর শরীরের ডান দিক অবশ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় কথা। সেটা ২০০৪ সাল। তাঁর বয়স তখন ৫১। বিছানায় শুয়ে চোখের জলে বালিশ ভিজত। মাস চারেক বিছানাতেই কাটে। তার পরেও আধা-পঙ্গু জীবন। পাহাড়-পাগল মানুষটার স্বপ্ন থেকে নির্বাসিত হয় বরফ-চূড়া। ডায়েরির পাতায় তারই প্রতিফলন হতো। হিমালয় তাঁকে টানে, কিন্তু বুঝতে পারেন অভিযাত্রী হিসাবে সেখানে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ফিকে হয়ে গিয়েছে।

সুনন্দ ঘোষ

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৮
নিশিকান্ত সেন

নিশিকান্ত সেন

ডায়েরির পাতায় প্রতি দিন একটাই লাইন লিখতেন ‘আর কোনও দিন হিমালয়ে যেতে পারব না।’ নীচে কাঁপা হাতে সই।

ঘনিষ্ঠরা ভেবেছিলেন, এ ভাবে চললে হয়তো পাগলই হয়ে যাবেন নিশিকান্ত সেন। আচমকা স্ট্রোকে তাঁর শরীরের ডান দিক অবশ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় কথা। সেটা ২০০৪ সাল। তাঁর বয়স তখন ৫১। বিছানায় শুয়ে চোখের জলে বালিশ ভিজত।

মাস চারেক বিছানাতেই কাটে। তার পরেও আধা-পঙ্গু জীবন। পাহাড়-পাগল মানুষটার স্বপ্ন থেকে নির্বাসিত হয় বরফ-চূড়া। ডায়েরির পাতায় তারই প্রতিফলন হতো। হিমালয় তাঁকে টানে, কিন্তু বুঝতে পারেন অভিযাত্রী হিসাবে সেখানে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ফিকে হয়ে গিয়েছে। ডায়েরির পাতায় কাঁপা কাঁপা হরফে লেখা একটি বাক্যে সেই যন্ত্রণাই ফুটে উঠত রোজ।

কিন্তু মন যে কিছুতেই বাঁধ মানতে চায় না। তাই হাল ছাড়েননি। পাহাড়ের নেশাই তাঁকে শরীরের বাধা জয় করার রসদ জোগাতে থাকে।

গত অক্টোবরে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প ঘুরে এসেছেন ষাটোর্ধ্ব মানুষটি। তা-ও আবার এমন একটা সময়ে, যখন হুদহুদ-এর জন্য অশান্ত হাওয়া প্রবল আক্রোশে আছড়ে পড়ছে পাহাড়ে। ছুঁচ-ফোটানো ঠান্ডা হাওয়া আর বরফ-বৃষ্টি মাথায় নিয়েই লক্ষ্যে পৌঁছেছেন হার-না-মানা নিশিকান্ত।

কী ভাবে করলেন এই অসাধ্যসাধন?

ফিজিক্যাল মেডিসিন এর চিকিৎসক মৌলিমাধব ঘটকের ব্যাখ্যা, “প্রবল মানসিক ইচ্ছার প্রতিফলন হয় মস্তিষ্কে। তার সঙ্গেই পারিপার্শ্বিক পরিবেশটা যদি সহায়ক হয়, তা হলে স্ট্রোকে যে ক্ষতি হয়েছে তার অনেকটাই পূরণ হওয়া সম্ভব।” তবে একেবারে শয্যাশায়ী অবস্থা থেকে ১৮ হাজার ফুট উঁচু এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে ছুঁয়ে আসার জন্য ঠিক কতটা মানসিক জোর প্রয়োজন, চিকিৎসকের মাপকাঠিতেও তা অবশ্য ধরা পড়ে না।

বিয়ে করেননি। দিদি, ভাগ্নে-ভাগ্নিদের নিয়ে সংসার নিশিকান্তর। হাইকোর্টে কেরানির চাকরি করলেও কোনও দিনই ‘হরিপদ কেরানি’-র জীবন কাটাননি। কাঁধে রুক-স্যাক, আইস এক্স নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন পাহাড়ে। কখনও ট্রেকিং, কখনও আবার লক্ষ্য আরও দুর্গম কোনও পাহাড় চুড়ো। এক সময়ে আনন্দবাজার ক্লাবে যোগ দেন। এই ক্লাবের পর্বতারোহণ দলের সদস্য হিসাবে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন মানালি থেকে। বাঘাযতীনের বাড়িতে তাঁর বিছানার পাশে তার পর থেকেই পাকাপাকি ভাবে ঠাঁই নেয় রুক-স্যাক, স্লিপিং ব্যাগ, আইস এক্স।

এমন মানুষকে একটানা বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে মুষড়ে পড়েছিলেন আত্মীয়-বন্ধুরা। আর মনের দুঃখ মনে চেপে, রোজ একটাই লাইন লিখে ডায়েরির পাতা ভরাতেন নিশিকান্ত।

স্ট্রোক হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে স্রেফ মনের জোরেই বিছানায় উঠে বসেন তিনি। পাহাড় ডিঙোনো মানুষটার নতুন জীবন শুরু হয় এর পর। লাঠির উপরে ভর করে ধীরে ধীরে হাঁটা, নতুন করে কথা বলা অভ্যাস করা। ভাগ্নি ডলি সিকদার মামার ছায়াসঙ্গী। তিনিও বিয়ে করেননি। জানালেন, “বেশি করে কথা বলাতাম মামাকে। যাতে তাড়াতাড়ি জড়তা কাটে। প্রতি দিন এক পাতা করে লেখাতামও।” তবে লড়াইটা সহজ ছিল না মোটেই। মাঝে মাঝেই হতাশ লাগত। এক বার তো হতোদ্যম হয়ে রুক-স্যাক, আইস-এক্স সমস্তই বিক্রি করে দিয়েছিলেন তিনি।

ক’দিন পর থেকে শুরু হয় অফিস। বাড়ির লোকেরা সঙ্গে যেতেন। ফেরার সময় পৌঁছে দিতেন এক বন্ধু। আর সেই সঙ্গে চলত চিকিৎসা। এক দিন এক চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে নিশিকান্ত বলে বসেন, “ডাক্তারবাবু, আমি আবার ট্রেকিংয়ে যেতে চাই।” বিরক্ত হয়ে চেম্বার থেকেই তাঁকে বেরিয়ে যেতে বলেন ওই চিকিৎসক। নিশিকান্তর কথায়, “ডাক্তারবাবুকে দোষ দিই না। ওঁর জায়গায় থাকলে আমিও হয়তো এটাই করতাম। পাগলের প্রলাপ মনে করতাম।”

কিন্তু শরীরটা একটু সুস্থ হতেই পাহাড়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা ফের চেপে বসে। এ বার নিশিকান্ত যান স্নায়ু-বিশেষজ্ঞদের কাছে। কিন্তু ওই শরীর নিয়ে পাহাড়ে চড়ার অনুমতি দিতে চাননি কেউই। শেষমেশ ভরসা জোগালেন চিকিৎসক সীতাংশুশেখর নন্দী। তিনি এবং নিশিকান্তর পারিবারিক চিকিৎসক কবীর দত্ত মিলে উৎসাহ দিতে শুরু করেন। সীতাংশুবাবুর কথায়, “মনের জোর তো ছিলই। চিকিৎসকদের কথা মতো ওষুধ খাওয়া, নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা, শরীরচর্চা সবই চলত নিয়ম মেনে। সব মিলিয়েই ফের পাহাড় ছোঁয়ার স্বপ্ন সফল হয়েছে নিশিকান্তবাবুর।”

এভারেস্ট বেস ক্যাম্প অভিযানে নিশিকান্তর সঙ্গী ছিলেন অম্লান মৈত্র। তিনি জানালেন, তিন বছর ধরে পরিকল্পনা চলছিল। কিন্তু নিশিকান্তর শরীর তখনও পুরোপুরি তৈরি নয়। অগত্যা বাতিল করা হয় অভিযান। অম্লানবাবুর কথায়, “নিশিদা যাওয়ার জন্য এতটাই উদগ্রীব ছিলেন যে ওঁকে ফেলে অভিযানে যাওয়ার কথা ভাবতে পারিনি। শেষে ২০১৪-এর ৩ অক্টোবর নিশিদাকে সঙ্গে নিয়েই কাঠমান্ডু থেকে বেরিয়ে পড়ি বেস ক্যাম্পের পথে।”

স্বপ্ন ছোঁয়ার আগে কান্না ভেজা ডায়েরিটা ছিঁড়ে ফেলতে অবশ্য ভোলেননি নিশিকান্ত!

nishikanto sen sunanda ghosh everest
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy