Advertisement
০৮ মে ২০২৪

আফসোস নিয়েই পাড়ুই ছাড়ল দত্ত এজলাস

পাড়ুই-মামলার নিষ্পত্তি করতে না-পারার আক্ষেপ তাঁর জীবনভর থেকে যাবে। এই মন্তব্য করে শুক্রবার মামলাটির বিচার-ভার থেকে অব্যাহতি নিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত। ফলে পাড়ুই-মামলা এ বার যাবে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে। তারাই ঠিক করে দেবে, অতঃপর কোন বিচারপতি মামলাটি শুনবেন। কিন্তু বিচারপতি দত্ত সরে গেলেন কেন? বিচারপতি দত্ত স্বয়ং ‘ব্যক্তিগত কারণের’ যুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু আইনজীবী মহলের একাংশ অন্য কারণ দেখছেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৪ ০৩:২৭
Share: Save:

পাড়ুই-মামলার নিষ্পত্তি করতে না-পারার আক্ষেপ তাঁর জীবনভর থেকে যাবে। এই মন্তব্য করে শুক্রবার মামলাটির বিচার-ভার থেকে অব্যাহতি নিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত।

ফলে পাড়ুই-মামলা এ বার যাবে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে। তারাই ঠিক করে দেবে, অতঃপর কোন বিচারপতি মামলাটি শুনবেন। কিন্তু বিচারপতি দত্ত সরে গেলেন কেন?

বিচারপতি দত্ত স্বয়ং ‘ব্যক্তিগত কারণের’ যুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু আইনজীবী মহলের একাংশ অন্য কারণ দেখছেন। ওঁদের বক্তব্য, হাইকোর্টে পাড়ুই-মামলার শুনানি চলাকালীন বিচারপতি দত্তের একটি লিখিত মন্তব্য ঘিরে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। সিদ্ধান্তটির পিছনে তারই যে মূল ভূমিকা, স্বয়ং বিচারপতি দত্তের কথায় সে ইঙ্গিত স্পষ্ট বলে এই মহলটির দাবি।

২০১৩-র ২১ জুলাই, চতুর্থ দফার পঞ্চায়েত ভোটের আগের রাতে বীরভূমের পাড়ুইয়ে, কসবা গ্রামের বাঁধ নবগ্রামে খুন হন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলকর্মী সাগর ঘোষ, যাঁর ছেলে হৃদয় ঘোষ নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। পুত্রবধূর অভিযোগ ছিল, শ্বশুরমশাইকে আহত অবস্থায় ফেলে রেখে পুলিশ জবরদস্তি তাঁদের দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়েছে, এবং তাতে ক’জনের নাম লিখে গ্রেফতার করে আসল অপরাধীদের আড়াল করেছে। হাইকোর্টের নির্দেশে পুলিশ সাগর-হত্যার এফআইআর নেয়, যাতে তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের পাশাপাশি বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীরও নাম আছে। কোর্টের কাছে পরিজনদের দেওয়া জবানবন্দিতেও অভিযুক্ত-তালিকায় অনুব্রতের নাম এক নম্বরে। অনুব্রত-বিকাশ অবশ্য এখনও অধরা। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পাড়ুই-তদন্তে বিশেষ দল (সিট) গড়ে দিয়ে হাইকোর্ট রাজ্য পুলিশের ডিজি’কে মূল তদন্তকারী নিযুক্ত করে।


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

এবং বিচারপতি দত্ত তাঁর লিখিত মন্তব্যে অনুব্রতকেই মুখ্যমন্ত্রীর ‘আশীর্বাদধন্য’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। লিখেছিলেন, ‘অনুব্রত মুখ্যমন্ত্রীর আশীর্বাদধন্য হওয়ায় সিটের প্রধান ডিজি এবং অন্য অফিসারেরা ওঁকে ছোঁয়ার সাহস করছেন না। সেই রাজনৈতিক সুযোগটি অভিযুক্ত পুরোপুরি ব্যবহার করছে। তদন্ত সঠিক পথে যে এগোচ্ছে না, এটাই তার কারণ।’ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ তাঁর মন্তব্যের এই অংশটি বাদ দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টেরও অভিমত, বিচারপতি এমন মন্তব্য করে ঠিক করেননি। যদিও বিচারপতি দত্ত এ দিন জানিয়েছেন, পাড়ুই-মামলার নিষ্পত্তি যদি তিনি করতেন, তা হলে বিভিন্ন সময়ে নিজের করা বিভিন্ন মন্তব্য ও মতামতের পক্ষেই অবিচল থাকতেন।

এরই প্রেক্ষাপটে আইনজীবীদের একাংশের পর্যবেক্ষণ: মন্তব্যের বাদ পড়া অংশে তিনি ভুল কিছু লিখেছিলেন বলে বিচারপতি দত্ত মনে করছেন না। এমতাবস্থায় তাঁর পক্ষে মামলাটি চালানো সম্ভব নয়। আইনজীবীদের অনেকের ধারণা, ওই আক্ষেপ থেকেই তিনি পাড়ুইয়ের ভার ছাড়লেন। বস্তুত এ দিন এজলাসে বিচারপতির একাধিক মন্তব্যের মধ্যে এই মনোভাবেরই প্রকাশ দেখেছেন অনেকে। কী হল এ দিন আদালতে?

বিচারপতি দত্ত এ দিন মামলার শুরুতে সরকারি কৌঁসুলি প্রণব দত্তকে বলেন তাঁর ১০ এপ্রিলের মন্তব্যটি পড়ে শোনাতে। প্রণববাবু পড়তে থাকেন। ইতিমধ্যে এজলাসে ঢোকেন রাজ্যের জিপি (গভর্নমেন্ট প্লিডার) অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়। “জিপি যখন এসে গিয়েছেন, তখন তাঁর কাছেই জানতে চাওয়া ভাল।” বলেন বিচারপতি দত্ত। জিপি’কে প্রশ্ন করেন, ‘‘১০ এপ্রিল যখন ডিজি-কে হাজির হতে নির্দেশ দিয়েছিলাম, তখন আপনি এজলাসে হাজির ছিলেন তো?’’

ইতিবাচক উত্তর শুনে বিচারপতি বলেন, ‘‘আবেদনকারীদের কৌঁসুলি সে দিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি ছবি আমাকে দেখিয়েছিলেন। তাতে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে অনুব্রত মণ্ডলকে দেখা যাচ্ছিল। তখন আমি জিপি-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এটা কি রাজনৈতিক ব্যাপার? জিপি বলেছিলেন, হ্যা।ঁ’’ জিপি বলে ওঠেন, ‘‘রাজনৈতিক ব্যাপার, এই কথাটা আমি তখন বলে থাকতে পারি, না-ও পারি।’’

এ বার বিচারপতি পরবর্তী ঘটনাক্রম সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘‘সে দিন আমার লিখিত মন্তব্যে সরকারপক্ষের কেউ আপত্তি তোলেনি। অথচ তার ক’ঘণ্টার মধ্যেই সরকার ডিভিশন বেঞ্চে চলে গেল!’’ জিপি-কে প্রশ্ন করেন, ‘‘১০ এপ্রিল আপনি এখানে কিছু বললেন না। এ দিকে পর দিনই ডিজি-র হাজিরা বন্ধ করতে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে গিয়ে সওয়াল করলেন! বললেন, আমার লিখিত মন্তব্য একপেশে ও অসূয়াপ্রসূত! কিন্তু সেটা আগের দিন আমার এজলাসে বললেন না?’’ বিচারপতি দত্তের ঘোষণা, ‘এই মামলা যদি আমি পুনরায় বিচার করি, রায়ে বা লিখিত মন্তব্যে একই মনোভাব ব্যক্ত হবে। আমি যে বিশ্বাসে দাঁড়িয়ে ছিলাম, এ দিনও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি।’

এর পরেই বিচারপতি দত্ত জানিয়ে দেন, তিনি পাড়ুই-মামলার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিচ্ছেন। ‘‘ব্যক্তিগত কারণে মামলাটি আমি শুনব না। তবে পাড়ুই-মামলার নিষ্পত্তি করতে না পারার জন্য আমৃত্যু আমার আফশোস থেকে যাবে।’’ বলেন তিনি।

বিচারপতির সিদ্ধান্ত শুনে আবেদনকারীরা পড়েছেন সংশয়ে। হৃদয়বাবুর কৌঁসুলি শীর্ষেন্দু সিংহরায়ের কথায়, “সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলেন নিহতের পরিজনেরা। আমাদের সন্দেহ, দোষীরা কি আদৌ শাস্তি পাবে?” হৃদয়বাবুর মন্তব্য, “আমরা অত্যন্ত হতাশ। উনি ব্যক্তিগত কারণের উল্লেখ করলেও আমাদের মনে হচ্ছে, এর পিছনে রাজ্য সরকারের মনোভাব ও পুলিশের একাংশের কিছু কার্যকলাপই দায়ী। বিচার প্রক্রিয়াও দীর্ঘায়িত হতে পারে।”

তবে মামলা যে বিচারপতির কাছেই যাক না কেন, হাইকোর্টের উপরে তাঁদের পূর্ণ আস্থা আছে বলে জানিয়েছেন হৃদয়বাবু। ওঁরা আশা রাখেন, নিরপেক্ষ তদন্ত হলে সাগরবাবুর খুনিরা শাস্তি পাবেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

parui case dipankar dutta calcutta highcourt
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE