Advertisement
০৪ মে ২০২৪
খাগড়াগড় কাণ্ড

এনআইএ-র তদন্তে বিপন্ন কোন শিশু, হদিসই নেই

খাগড়াগড়ের সন্ত্রাস-তদন্তে এক্তিয়ারভঙ্গ ও প্রশাসনিক অসহযোগিতার প্রশ্নে এত দিন কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের সঙ্গে রাজ্য সরকারের চাপান-উতোর চলছিল। এ বার ‘শিশু-সুরক্ষা’র প্রেক্ষাপটে কার্যত তা সম্মুখ সমরের চেহারা নিল। যদিও কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ)-র বিরুদ্ধে রাজ্যের তোলা শিশু-সুরক্ষা লঙ্ঘনের অভিযোগটির পিছনে তৃণমূলের রাজনৈতিক অভিসন্ধির ছায়া দেখতে পাচ্ছে প্রশাসনের একাংশ। আর যাকে ঘিরে এত কাণ্ড, খোঁজ-খবর চালিয়ে সেই কিশোরেরও কোনও হদিস মেলেনি।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১১
Share: Save:

খাগড়াগড়ের সন্ত্রাস-তদন্তে এক্তিয়ারভঙ্গ ও প্রশাসনিক অসহযোগিতার প্রশ্নে এত দিন কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের সঙ্গে রাজ্য সরকারের চাপান-উতোর চলছিল। এ বার ‘শিশু-সুরক্ষা’র প্রেক্ষাপটে কার্যত তা সম্মুখ সমরের চেহারা নিল। যদিও কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ)-র বিরুদ্ধে রাজ্যের তোলা শিশু-সুরক্ষা লঙ্ঘনের অভিযোগটির পিছনে তৃণমূলের রাজনৈতিক অভিসন্ধির ছায়া দেখতে পাচ্ছে প্রশাসনের একাংশ। আর যাকে ঘিরে এত কাণ্ড, খোঁজ-খবর চালিয়ে সেই কিশোরেরও কোনও হদিস মেলেনি।

খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত রেজাউল করিমের বর্ধমানের বাড়িতে তল্লাশিতে গিয়ে এনআইএ শিশু-সুরক্ষা অধিকারের তোয়াক্কা করেনি বলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে চিঠি দিয়ে রাজ্য শিশু-সুরক্ষা আয়োগ-কে জানানো হয়েছে। রাজ্য আয়োগ মারফত সেটি জাতীয় শিশু-সুরক্ষা আয়োগের কাছে পেশও হয়ে গিয়েছে। বর্ধমানের জেলাশাসকের লেখা ওই চিঠির দাবি, রেজাউলের বাদশাহি রোডের বাড়িতে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা বোমা খোঁজার কাজে লাগিয়েছিলেন এক কিশোরকে। শেখ ফিরোজ নামে ছেলেটির ঠিকানা ও অভিভাবকের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ঘটনা হল, উল্লিখিত ঠিকানায় গিয়ে ফিরোজ বা তার অভিভাবক কারও দেখা মেলেনি।

এবং এতে জেলাশাসকের দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে, যা জোরদার করছে পাল্টা অভিযোগের তিরকে। পুলিশ-প্রশাসনের অনেকে মনে করছেন, পুরো উদ্যোগের নেপথ্যে শাসকদলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের প্রয়াস রয়েছে।

বস্তুত খাগড়াগড়ের তদন্তভার এনআইএ-র হাতে যাওয়া ইস্তক রাজ্য সরকার তার প্রতিবাদে সরব। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী। অন্য দিকে তদন্তে অসহযোগিতার অভিযোগ এনে রাজ্য পুলিশকে বিঁধেছিল এনআইএ। তবে খাগড়াগড়ের তদন্ত যত এগিয়েছে, রাজ্যের অস্বস্তি তত বেড়েছে। ঘটনায় বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন জেএমবি-সহ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস-চক্রের যোগসূত্র পাওয়া গিয়েছে। বাংলাদেশের মৌলবাদী সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছেন শাসকদলের সাংসদ।

এমতাবস্থায় রাজনৈতিক ভাবে বেকায়দায় পড়া তৃণমূল শিশু-সুরক্ষার প্রশ্নকে হাতিয়ার করে এনআইএ তথা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে চাইছে বলে একান্ত আলাপচারিতায় মত প্রকাশ করেছেন রাজ্য প্রশাসনের একটি মহল। ঘটনা সম্পর্কে জেলা পুলিশের অজ্ঞতাও তাঁদের সংশয় বাড়িয়েছে। রাজ্যের নালিশটা ঠিক কী?

বর্ধমানের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন তাঁর চিঠিতে (মেমো নম্বর-১১৭২/এস ডব্লিউ/বি ডব্লিউ এন) রাজ্য শিশু-সুরক্ষা আয়োগ-কে জানিয়েছেন, গত ১৬ অক্টোবর রেজাউলের বাড়িতে এনআইএ-র তল্লাশি চলাকালীন তেরো বছরের এক কিশোরকে দিয়ে বোমাভর্তি চটের বস্তা খোলানো হয়েছিল। ‘এনআইএ-র তল্লাশির সময় শিশু-সুরক্ষার অধিকার-আইন মারাত্মক ভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে।’ লিখেছেন ডিএম। চিঠিতে তাঁর এ-ও দাবি, বর্ধমান জেলার সমাজকল্যাণ আধিকারিক ও জেলার শিশু-সুরক্ষা আধিকারিক তদন্তে অভিযোগটি প্রমাণিত হয়েছে।

জেলাশাসকের চিঠি পেয়ে রাজ্য আয়োগের চেয়ারম্যান অশোকেন্দু দাশগুপ্ত অভিযোগটি দিল্লির জাতীয় শিশু সুরক্ষা আয়োগে পাঠিয়ে দিয়েছেন। যাদের দিকে আঙুল, সেই এনআইএ-র এক শীর্ষ কর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, “কোনও বাচ্চাকে এমন কাজে লাগানোর কথা নয়। তা-ও অভিযোগ উঠল কেন, খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

সে দিন ঠিক কী হয়েছিল, জানানোর জন্য ফিরোজকে অবশ্য পাওয়া যায়নি। রাজ্যের সমাজকল্যাণ আধিকারিকেরা দাবি করেছিলেন, ফিরোজ স্থানীয় কেষ্টপুর হাইস্কুলের ছাত্র, স্কুলের খাতা অনুযায়ী যার জন্ম তারিখ ২০০১-এর ১০ মার্চ। বাবা শেখ লাল্টু প্রয়াত। মায়ের নাম টুনি বিবি, তিনি কাচের চুড়ি বিক্রি করেন। তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে ফিরোজ সকলের ছোট। দেখা করতে গত ১০ জানুয়ারি ফিরোজের ঠিকানায় যাওয়া হয়েছিল। গোটা তল্লাট চষেও ওই নামে কোনও কিশোর, তার মা কিংবা ভাই-বোনের দেখা মেলেনি। স্থানীয় লোকজনও এমন কোনও পরিবারের খোঁজ দিতে পারেননি। কেষ্টপুর হাইস্কুলে গেলে প্রধান শিক্ষক সৌমেন কোনার খাতা-পত্র ঘেঁটে জানান, শেখ ফিরোজ নামে একটি ছেলে ২০১০-এ ক্লাস সিক্সে পড়ত বটে। তবে ওই বছরই সে স্কুল ছেড়ে দেয়।

তা হলে অভিযোগের ভিত্তি কী?

জেলাশাসক জানান, তিনি নিজে ছেলেটিকে দেখেননি। কিন্তু জেলার সমাজকল্যাণ আধিকারিক ও শিশু-সুরক্ষা আধিকারিক তার সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছেন। তাঁদের রিপোর্টের ভিত্তিতেই তিনি অভিযোগটি করেছেন। বর্ধমানের সমাজকল্যাণ আধিকারিক অনির্বাণ চক্রবর্তীর বক্তব্য: ২২ অক্টোবর তিনি শিশু-সুরক্ষা আধিকারিক সুদেষ্ণা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রেজাউলের বাড়ির আশপাশ সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। পরে ফিরোজকে অফিসে ডেকে তার বক্তব্যের ভিডিও রেকর্ডিং হয়। ফিরোজ সেখানে কী বলেছিল?

অনির্বাণবাবুর দাবি: ফিরোজ জানিয়েছে, অনেকের সঙ্গে সে-ও রেজাউলের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এনআইএ-র তল্লাশি দেখছিল। হঠাৎ গোয়েন্দারা ওকে ভিতরে ডেকে তাকের উপরে উঠতে বলেন। ওখানে কয়েকটা মুখ-বাঁধা বস্তা ছিল। গোয়েন্দারা বলেন, বস্তার মুখ খুলে দেখতে। ফিরোজ দেখে জানায়, লোহার যন্ত্রপাতি, ছোট লাঠির মতো জিনিসপত্র রয়েছে। শুনে গোয়েন্দারা ওকে নেমে আসতে বলেন। অনির্বাণবাবু বলেন, “চার অফিসারের এক জন পুলিশের পোশাকে ছিলেন বলে ছেলেটি জানিয়েছে। এ-ও বলেছে, বস্তায় বিস্ফোরক রয়েছে জানলে সে কিছুতেই তাকের উপরে উঠত না।” কিন্তু ছেলেটি গেল কোথায়?

অনির্বাণবাবুর জবাব, “সম্ভবত পরিবারটি ভিন রাজ্য থেকে কাজ খুঁজতে এসেছিল। মনে হচ্ছে, কাজের সন্ধানেই অন্য কোথাও চলে গিয়েছে।” এত গুরুতর অভিযোগের মূল সাক্ষীকে কেন এলাকা ছাড়তে দেওয়া হল, তার ব্যাখ্যা যদিও মেলেনি। আরও আশ্চর্য, ফিরোজ-কাণ্ড সম্পর্কে জেলা পুলিশই অন্ধকারে। “রেজাউলের বাড়িতে কোনও বাচ্চাকে দিয়ে বিস্ফোরক ভর্তি বস্তা খোলানো হয়েছে, এমন ঘটনা জানা নেই। ডিএম’কে জিজ্ঞাসা করুন।” পরিষ্কার বলেন বর্ধমানের এসপি সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা। তাতে অবশ্য শাসকদলের কাছে অভিযোগের গুরুত্ব খাটো হচ্ছে না। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “তদন্তের নামে এনআইএ যাকে দিয়ে যা ইচ্ছে করাবে, তা হতে পারে না। এ তো সম্পূর্ণ বেআইনি! বোমা ফেটে বাচ্চাটি মারা গেলে কী হতো!’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের পাল্টা তোপ, “এনআইএ-তদন্তের সাফল্য মুখ্যমন্ত্রীর মুখ পুড়িয়েছে। তাই এ সব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ।”

সহ প্রতিবেদন: উদিত সিংহ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

khagragarh blast parijat bandyopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE