Advertisement
০৫ মে ২০২৪

এসপি-র রিপোর্ট, তবু মেজাজেই ছিল জিয়াউল

খাগড়াগড় কাণ্ডে এনআইএ-র হাতে সরাসরি ধৃত প্রথম ব্যক্তি সে। জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর চাঁইদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে তদন্তকারীদের দাবি। অথচ গত ৭ নভেম্বর সে গ্রেফতার হওয়ার প্রায় আড়াই বছর আগে থেকে হাইস্কুল শিক্ষক জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে তিন-তিনটি নেতিবাচক রিপোর্ট দিয়েছিলেন বর্ধমান জেলার পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা। রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তারা ওই রিপোর্ট পান। তার পরেও কেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, খাগড়াগড় কাণ্ডের তদন্তে নেমে এনআইএ তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে।

সুরবেক বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৫৯
Share: Save:

খাগড়াগড় কাণ্ডে এনআইএ-র হাতে সরাসরি ধৃত প্রথম ব্যক্তি সে। জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর চাঁইদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে তদন্তকারীদের দাবি। অথচ গত ৭ নভেম্বর সে গ্রেফতার হওয়ার প্রায় আড়াই বছর আগে থেকে হাইস্কুল শিক্ষক জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে তিন-তিনটি নেতিবাচক রিপোর্ট দিয়েছিলেন বর্ধমান জেলার পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা। রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তারা ওই রিপোর্ট পান। তার পরেও কেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, খাগড়াগড় কাণ্ডের তদন্তে নেমে এনআইএ তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে।

এনআইএ সূত্রের খবর, ওই তিনটি রিপোর্টে বর্ধমানের এসপি সাফ জানিয়েছিলেন, জিয়াউলের উস্কানিমূলক প্রচার যাবতীয় সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে। এর ফলে গোটা এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে খারাপ প্রভাব পড়বে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও গুরুতর সমস্যা হতে পারে। প্রথম রিপোর্টটি তিনি দেন ২০১২-র ২৯ জুন। এর পর ওই বছরেরই ৫ সেপ্টেম্বর রাজ্য পুলিশের শীর্ষ মহলে তিনি যে রিপোর্টটি পাঠান, তাতে বলা হয়েছিল, ‘জিয়াউল হক নামে স্কুলের আরবি ভাষার ওই শিক্ষক অন্য গোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর মাধ্যমে পরিবেশ কলুষিত করছেন। বিষিয়ে দিচ্ছেন সরলমতি স্কুলপড়ুয়াদের মন। বৃহত্তর স্বার্থে তাই ওই শিক্ষককে অন্যত্র বদলি করা হোক।’ বারবার বলা সত্ত্বেও জিয়াউল নিজেকে শোধরায়নি বলে এসপি জানিয়েছিলেন। এসপি সর্বশেষ রিপোর্টটি দেন ২০১৩-র ৩১ জানুয়ারি।

অথচ তার পরেও জিয়াউলের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, তাঁর উপর নজরদারিও হয়নি বলে জেনেছে এনআইএ। তদন্তকারীদের বক্তব্য, পুলিশ-প্রশাসনের এই ঢিলেমির সুযোগেই জিয়াউল বর্ধমানের তালিত গৌড়েশ্বর হাইস্কুলে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি বাংলাদেশের জেএমবি শিবিরে গিয়ে জেহাদি প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিল। বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদের বেশ কয়েক জন মহিলা-পুরুষকে সে জেহাদি ভাবধারায় দীক্ষিত করেছে অবাধে।

বর্ধমানের এসপি মির্জাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি কোনও মন্তব্য করেননি। তবে রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “আমরা বর্ধমানের এসপি-র ওই রিপোর্ট পেয়েছিলাম। সেই মতো ওই শিক্ষকের উপর অনবরত নজরদারি ও ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও ভেবেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু করা যায়নি।” কেন? ওই অফিসারের কথায়, “সেটা বলা যাবে না।”

আর শুধু এসপি নন, ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মানস হাজরা এবং পরিচালন সমিতির সম্পাদক মতিয়ার রহমান চৌধুরীও ২০১২-র ১৭ অগস্ট জেলা স্কুল পরিদর্শককে দু’পাতার একটি চিঠি দিয়ে জিয়াউলের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তাতেও যে কাজের কাজ হয়নি, দেখাই যাচ্ছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর এনআইএ জেনেছে, মূলত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপেই পুলিশ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও জিয়াউলের ব্যাপারে খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেনি।

তালিত গৌড়েশ্বর হাইস্কুলটি যেখানে, বর্তমানে সেই এলাকা থেকে নির্বাচিত জেলা পরিষদের তৃণমূল সদস্য হলেন নুরুল হাসান। তাঁর ঘনিষ্ঠ গোলাম আমবিয়া ওই স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি। এনআইএ জানতে পেরেছে, এসপি-র রিপোর্টে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল যে, গোলাম আমবিয়ার মদতেই জিয়াউল মাসের পর মাস অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ প্রচার করে গিয়েছে। এবং নুরুলের জন্যই যে তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি, সেই ইঙ্গিতও রিপোর্টে ছিল।

বর্ধমানে এই মুহূর্তে স্থায়ী ভাবে জেলা স্কুল পরিদর্শক পদে কেউ নেই। তবে জিয়াউল পড়ুয়াদের উত্ত্যক্ত করছিলেন বলে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও পরিচালন সমিতির সম্পাদক যে অভিযোগ জানিয়েছিলেন, সে কথা মেনে নিয়েছেন বর্ধমানের তৎকালীন জেলা স্কুল পরিদর্শক (মাধ্যমিক), বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত আব্দুল হাই। তাঁর কথায়, “আমরা সবাই বসে তখন মিটিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু ওই শিক্ষককে বদলি করতে চেয়ে পুলিশ সুপারের রিপোর্টের ব্যাপারে আমাকে কিছু জানানো হয়নি।” হাইয়ের বক্তব্য, জিয়াউল স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় পাশ করে ওই স্কুলে চাকরি পেয়েছিলেন। তাঁকে হঠাৎ বদলি করা যেত না।

মজার কথা হল, জিয়াউল গ্রেফতার হওয়ার পর এখন কেউই কাউকে ‘চিনতে’ পারছেন না। স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি গোলাম আমবিয়া বলছেন, “স্কুলের মিটিংয়ে দু’-এক বার ওই শিক্ষককে দেখেছিলাম। তেমন চিনতাম না। এর চেয়ে বেশি কিছু আমি সাংবাদিককে বলতে বাধ্য নই।” আর তৃণমূল নেতা নুরুল হাসানের বক্তব্য, “গোলাম আমবিয়া নামে কাউকে আমি চিনি না। তবে আমাদের দলের কর্মী হলে তিনি আমাকে চিনতেই পারেন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

khagragarh blast surbek biswas ziaul haque nia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE