Advertisement
১১ মে ২০২৪

কী করে স্কুল যাব, চিন্তায় সুজাইরা

কবে স্কুলে যেতে পারবে জানে না সালমার। ফের পুলিশ আসছে খবর পেয়ে, সেই ভোর রাতে মা-বাবার হাত ধরে মাঠ পেরিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। তালিবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ওই পড়ুয়া আর তার বন্ধুদের বই-খাতা, ভিটে-মাটি আর সবই পড়ে রয়েছে পুলিশি প্রহরায় জনশূন্য চৌমণ্ডলপুরে! বোমা উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার পরেই তল্লাশির নামে পুলিশ তাণ্ডব চালায় বলে অভিযোগ।

সুনসান চৌমণ্ডলপুর। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

সুনসান চৌমণ্ডলপুর। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

মহেন্দ্র জেনা
পাড়ুই শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:০২
Share: Save:

কবে স্কুলে যেতে পারবে জানে না সালমার। ফের পুলিশ আসছে খবর পেয়ে, সেই ভোর রাতে মা-বাবার হাত ধরে মাঠ পেরিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। তালিবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ওই পড়ুয়া আর তার বন্ধুদের বই-খাতা, ভিটে-মাটি আর সবই পড়ে রয়েছে পুলিশি প্রহরায় জনশূন্য চৌমণ্ডলপুরে!

বোমা উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার পরেই তল্লাশির নামে পুলিশ তাণ্ডব চালায় বলে অভিযোগ। তার পর থেকে সালমার মতো দুর্বিপাকে পড়েছে ইলামবাজার ব্লকের মঙ্গলডিহি পঞ্চায়েতের গোটা চৌমণ্ডলপুর। হাজার খানেক বাসিন্দার ওই গ্রামে রবিবার গিয়েও দেখা যায়-- গ্রাম জনশূন্য। দূরের আস্তানায় লুকিয়ে থাকা পরিবারগুলি ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা যেমন শিকেয় উঠেছে। একই ভাবে দুর্ভোগে পড়েছেন অসুস্থ ব্যক্তিদের পরিবারগুলিও।

এ দিন জনশূন্য চৌমণ্ডলপুর গিয়ে দেখা যায়, গ্রাম কার্যত পুলিশি সুরক্ষা বাহিনীর ‘দখলে’। এলাকা ঢোকার ২ কিলোমিটার আগে থেকেই গ্রাম মুড়ে ফেলা হয়েছে কড়া প্রহরায়। যে সমস্ত রাস্তাগুলি অন্য গ্রামের সঙ্গে চৌমণ্ডলপুরকে যুক্ত করেছে, সেই সব রাস্তাগুলিতেও বসেছে ব্যারিকেড। কেউ প্রবেশ করতে গেলেই পুলিশি প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। নিজেদের গ্রামের দিকে আঙুল তুলে সালমার সহপাঠী সেখ সুজাই বলছিল, “কি করে জানব, ফিরব না আর? সব তো ফেলে এসেছি। পুলিশ এসে গ্রামের সবাইকে খুব মারল সেদিন রাতে। ঘরের ভিতর ঢুকে উল্টে দিল সব।”

হাট করে দরজা খোলা, বাসিন্দারাই নেই। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, শুধু চৌমণ্ডলপুর নয়, গত দেড় দিনে দশ বার তল্লাশি অভিযান চলেছে লাগোয়া রাঘাইপুর, মাঘড়া, বেলপাতা, আমলাডিহি, হজপুর এলাকায়। এলাকার বাসিন্দাদের আশ্রয় দিলে তল্লাশি অভিযান জারি থাকবে, এমন ফতোয়া জারি হয়েছে আশপাশের এলাকায়। এলাকার মানুষ বলছেন, পুলিশ এবং তৃণমূলের লোক এসে বলেছে, প্রয়োজনে তাঁদের বাড়িতেও চলবে তাণ্ডব। পুলিশের এ হেন ফতোয়ায় তটস্থ চৌণ্ডলপুরকে কেন্দ্র করে কার্যত পুরো পাড়ুই এলাকাই থমথমে।

এলাকার অভিযোগ, অভিযুক্তদের ধর পাকড়ের অছিলায় গ্রামে ঢুকে পুরুষ-মহিলা-শিশু নির্বিশেষে বেশির ভাগ মানুষের ওপর অত্যাচার এবং বাড়িতে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়েছে পুলিশ। শনিবার রাতে এবং রবিবার সকাল থেকে দফায় দফায় র্যাফ, কমব্যাট ফোর্স ও জেলা পুলিশ দিয়ে তল্লাশি অভিযান চলে। কার্যত গোটা গ্রাম জন মানব শূন্য করার অভিযোগ উঠেছে জেলা পুলিশের বিরুদ্ধেই।

বোলপুর ব্লক সভাপতি বলাই চট্টোপাধ্যায় বলেন, “গ্রামে এবং লাগোয়া এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করার জন্য আতঙ্কিত লাগোয়া এলাকার মানুষও ঘর ছানছেন। স্কুল পড়ুয়া থেকে গর্ভবতী মহিলা, বৃদ্ধ মানুষেরা কার্যত চরম হেনস্থার মুখে পড়েছেন। স্কুল ছাত্ররা জানে না কিভাবে স্কুল যাবে।”

চৌমণ্ডলপুর গ্রামের উত্তরপাড়ার বাসিন্দা আবদুল মান্নান, হাসমেহারা বিবি, শাহানা বিবি, খদ্রিজা বিবি, মারিয়ম বিবিরা গোপন ডেরা থেকে জানান, পুলিশের অত্যাচারে স্কুল পড়ুয়া বাচ্চার পর্যন্ত বাড়িতে থাকার সাহস পাচ্ছে না। ওদের কেউ ছাড়েনি পুলিশ। বাড়ি, গরু, ছাগল, সব ছেড়ে পুলিশ আর তৃণমূলের অত্যাচারের ভয়ে পালিয়ে এসেছি।

এ দিন সিউড়ি আদালতে নিয়ে যাওয়ার পথে
চৌমণ্ডলপুরের ধৃত দুই মহিলা। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

এ দিন গ্রামে আই জি পশ্চিমাঞ্চল সিদ্ধিনাথ গুপ্ত এসেছিলেন বলেও এলাকায় পুলিশের সংখ্যা ছিল একটু বেশি। জেলা পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়াকে সঙ্গে নিয়ে সিউড়ি থেকে গ্রামের ঘটনাস্থল গুলি ঘুরে দেখেন তিনি। শুধু গ্রাম নয়, সংলগ্ন মাঠের মধ্যেও ছিল প্রহরা।

দূরের গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন চৌমণ্ডলপুরের পশ্চিম পাড়ার বাসিন্দা, হাঁসরা বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সুরেয়া খাতুন, নবম শ্রেণির ফিরোজা খাতুনরা বলেন, “পুলিশি তাণ্ডব এবং হেনস্থার ভয়ে ঘর-বাড়ি-পড়া ছেড়ে লোকের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। কি করব বুঝতে পারছি না।” একই অবস্থা, পশ্চিম পাড়ার বাসিন্দা ফতেমা বিবি, দক্ষিণ পাড়ার কোহিনুর বিবিদেরও।

জানা গেল, মাঝ পাড়ার বাসিন্দা মনিরা বিবি, বিজলি বিবি এবং ডোম পাড়ার বাসিন্দা লক্ষ্মী বাদ্যকর, ছায়া বাদ্যকর গর্ভবতী। এলাকার বাসিন্দা শেখ জামসেদ আলিদের ক্ষোভ, “এই মহিলাদের চিকিৎসার প্রয়োজন। পুলিশি তাণ্ডবের জেরে এঁদের গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হচ্ছে। এহেন হেনস্থা কেন আমাদের করা হচ্ছে? গোটা গ্রাম কী অপরাধ করল?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE