Advertisement
০৭ মে ২০২৪

কিনতে গেলে জমি পাবে না শিল্প, মানলেন মমতা

আংশিক বোধোদয়। বণিকসভা ফিকি-র মঞ্চে জমি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কিছুটা অবস্থান বদলকে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করছে শিল্পমহল। তবে তাঁদের মতে, শুধু এতে চিঁড়ে ভিজবে না। রাজ্যকে লগ্নির গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরতে আরও বহু মাইল পাড়ি দিতে হবে রাজ্যকে। পাল্টাতে হবে ভাবমূর্তি। শোধরাতে হবে বিনিয়োগের পরিবেশও। শুক্রবার কলকাতায় ফিকি-র জাতীয় কাউন্সিলের বৈঠকে মমতা বলেন, “জমি কিনতে যাবেন না। শিল্পপতিরা তা পারবেন না। আমাদের কাছে আসুন। জমি-ব্যাঙ্ক থেকে জমি দেব। তথ্যপ্রযুক্তি, ছোট ও মাঝারি শিল্প জমি চান, জমি দেব।”

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:২৭
Share: Save:

আংশিক বোধোদয়।

বণিকসভা ফিকি-র মঞ্চে জমি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কিছুটা অবস্থান বদলকে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করছে শিল্পমহল। তবে তাঁদের মতে, শুধু এতে চিঁড়ে ভিজবে না। রাজ্যকে লগ্নির গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরতে আরও বহু মাইল পাড়ি দিতে হবে রাজ্যকে। পাল্টাতে হবে ভাবমূর্তি। শোধরাতে হবে বিনিয়োগের পরিবেশও।

শুক্রবার কলকাতায় ফিকি-র জাতীয় কাউন্সিলের বৈঠকে মমতা বলেন, “জমি কিনতে যাবেন না। শিল্পপতিরা তা পারবেন না। আমাদের কাছে আসুন। জমি-ব্যাঙ্ক থেকে জমি দেব। তথ্যপ্রযুক্তি, ছোট ও মাঝারি শিল্প জমি চান, জমি দেব।”

মুখ্যমন্ত্রীর এই আহ্বানেই এ দিন জমি নিয়ে তাঁর অবস্থান অন্তত কিছুটা বদলের গন্ধ পেয়েছেন শিল্পপতিরা। কারণ, জমি-ব্যাঙ্ক থেকে জমি দেওয়ার কথা এর আগেও বহু বার বলেছেন মমতা। কিন্তু সরাসরি জমি কিনতে শিল্প যে অসুবিধায় পড়ে, আগে কখনও তা স্বীকার করেননি। বরং ক্ষমতায় আসার পরেই তাঁর সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল, শিল্পের জন্য জমি-মালিকদের কাছ থেকে সরাসরি জমি কেনার দায় বিনিয়োগকারীরই।

ক্ষমতায় আসার এক মাস পরেই ২০১১ সালের জুন মাসে শিল্পমহলের সঙ্গে প্রথম বার মুখোমুখি হয়ে মমতা জানিয়েছিলেন, শিল্প গড়তে যাবতীয় প্রশাসনিক সহায়তা তাঁরা দেবেন। কিন্তু জমি-নীতি বদলাবে না। ওই বৈঠকে আইটিসি-র কর্ণধার ওয়াই সি দেবেশ্বর-সহ অনেক শিল্পপতিই সরাসরি জমি কেনার সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। দেবেশ্বর খোলাখুলি জানিয়েছিলেন যে, ওই ভাবে জমি কেনা কঠিন কাজ। লগ্নির ক্ষেত্রেও তা বাধা হিসেবে গণ্য করতে পারেন শিল্পপতিরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী তখন স্পষ্ট বলেছিলেন, জমি কেনার কাজ শিল্পপতিরাই করবেন। জোর করে জমি অধিগ্রহণ বা তার দাম ঠিক করার কাজ তাঁর সরকার করবে না।

পরের বছর শিল্পপতিদের সঙ্গে প্রথম বিজয়া সম্মিলনীতেও একই বার্তা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তখন টাটা গোষ্ঠীর এক সংস্থার কর্তা বলেছিলেন, রাস্তার মতো পরিকাঠামো গড়তে সরকার জমি দিলে ভাল। কিন্তু মমতার জবাব ছিল, প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় রাস্তা তৈরির জমিও জোগাড় করতে হবে লগ্নিকারীকেই।

সেই জেদি, একবগ্গা অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, “জমি কিনতে যাবেন না। শিল্পপতিরা তা পারবেন না।” রাজ্যের শিল্পমহলের এক বড় অংশ বলছেন, “অবশেষে এ হল তৃণমূল-সরকারের আংশিক বোধোদয়। শুধু তা হতেই ক্ষমতায় আসার পর তিন বছর লেগে গেল।”

বড় শিল্পের জন্য একলপ্তে বেশি জমি সরাসরি কেনা যে কতখানি অসুবিধার, আজ বহু দিন ধরেই তা বলে আসছে শিল্পমহল। মুখ্যমন্ত্রী যে শেষ পর্যন্ত সেই সমস্যার কথা অন্তত মানলেন, তাতে কিছুটা খুশি তাঁরা। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁদের প্রশ্ন, শুধু জমি-ব্যাঙ্কের কুমিরছানা দেখিয়ে লাভ নেই। তার সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য কোথায়? সত্যিই কি সেখানে এক লপ্তে বেশি জমি মিলবে? যদি তা থেকেও থাকে, সেখানে পরিকাঠামো কেমন? রাজ্যের এক শিল্পকর্তা বলছিলেন, তথপ্রযুক্তি বা ছোট-মাঝারি শিল্পে হয়তো তুলনায় কম জমি লাগে। কিন্তু বড় শিল্পের জন্য জমি আছে কিনা, সরকার তা জানায়নি। আর বড় শিল্পই যদি না হয়, তা হলে ছোট-মাঝারি শিল্প বাঁচবে কী ভাবে? আর এক শিল্পকর্তার প্রশ্ন, “ধরুন, জমি-ব্যাঙ্কে দেখা গেল ঝাড়গ্রামে অনেক জমি রয়েছে। কিন্তু সেখানে শিল্প গড়ার পরিকাঠামো কোথায়? সেখানে কি সত্যিই টাকা ঢালতে আগ্রহী হবে কোনও সংস্থা?”

জমি নিয়ে সরকার হাত গোটালে, শিল্প যে কতখানি অসুবিধায় পড়ে, তা স্পষ্ট বিভিন্ন সমীক্ষা আর শিল্পপতিদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে। বছর দুয়েক আগে সিআইআই ও উপদেষ্টা সংস্থা আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং-এর সমীক্ষা জানায়, রাজ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জমি নিয়ে সমস্যায় আটকেছে লগ্নি। থমকেছে সম্প্রসারণ পরিকল্পনা। ফলে দক্ষ মানবসম্পদ, কাঁচামাল, বিদ্যুৎ ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগ আসেনি। এক শিল্প-কর্তাও জানাচ্ছেন জমি-জট নিয়ে তাঁদের নিদারুণ অভিজ্ঞতা। জমি-সমস্যার জন্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের কথামতো প্রকল্প অন্য জায়গায় সরাতে রাজি হয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু দেখেন, সে জন্য জমির দাম অন্তত পাঁচ গুণ বেড়ে গিয়েছে। তার উপর সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা বলেও কিছু নেই!

তা ছাড়া, জমি-জটই এ রাজ্যে একমাত্র সমস্যা নয়। শিল্পমহলের মতে, রাজ্যে লগ্নি আসার পথে বড় বাধা তার ভাবমূর্তিও। যেমন, বিশেষ আর্থিক অঞ্চল নিয়ে রাজ্যের অনড় অবস্থানের জেরে অনিশ্চিত হচ্ছে ইনফোসিসের প্রকল্প। যা রাজ্যের পক্ষে ভাল বিজ্ঞাপন নয়। এর সঙ্গে রয়েছে তোলাবাজির সমস্যা। ‘নিজেদের’ লোক নেওয়ার চাপ, ইট-বালি-সিমেন্টের সিন্ডিকেট ইত্যাদিতে নাভিশ্বাস উঠছে শিল্পের। তালা পড়ছে একের পর এক কারখানায়। তাঁদের প্রশ্ন, এ সব দেখেও এ রাজ্যে টাকা ঢালতে কেউ উৎসাহিত হবেন কেন?

অনেকে বলছেন, ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে বিজেপি-সহ বিরোধীরা যে সরকারকে লগ্নি না-আসা কিংবা শিল্পের বেহাল দশা নিয়ে আক্রমণ করবে, তা বিলক্ষণ বুঝছেন মমতা। হয়তো সেই কারণেই এ দিন জমি-নীতি নিয়ে কিছুটা উল্টো কথা বলেছেন তিনি। শিল্পকে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যে, জমি কিনতে গিয়ে দালাল-চক্রের খপ্পরে পরার যন্ত্রণা তিনি বোঝেন। জানেন, গত কয়েক বছরে তার রমরমা কী ভাবে বেড়েছে। কিন্তু শিল্পের প্রশ্ন, শুধু আশ্বাসে লগ্নি টানার চিঁড়ে আদৌ ভিজবে কি?

কোর কমিটি। টাস্ক ফোর্স। এক-জানালা ব্যবস্থা। শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠক। লগ্নি টানার জন্য বার্তা দিতে প্রথম থেকেই এ সব করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। বারবার বলা হয়েছে, রাজ্যে এলে অসুবিধা হবে না শিল্পপতিদের। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিনিয়োগ সে ভাবে আসেনি। কারণ বাস্তবে দেখা গিয়েছে, জমি-নীতিতে আটকে যাচ্ছে বড় লগ্নির প্রস্তাব। সেজ-নীতিতে থমকে যাচ্ছে ইনফোসিসের মতো সংস্থার প্রকল্প। ঝামেলায় পড়ে বন্দর ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে এবিজি। একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিন্ডিকেট, তোলাবাজির চাপে। এ সবের সঙ্গে লাল ফিতের ফাঁস আর প্রশাসনিক গড়িমসি তো রয়েইছে। শিল্পমহলের মতে, এই পরিস্থিতিতে বদল না-এনে শুধু জমি-ব্যাঙ্কের গল্প শুনিয়ে লগ্নি কতটা আসবে, সেই সংশয় থেকেই যাচ্ছে। যেমন, রাজ্যে শ্রমদিবস নষ্ট না-হওয়ার কথা বারবার বলেন মমতা। কিন্তু এ দিন তাঁর সামনেই রাজ্যে শ্রমিক অসন্তোষ এবং তার জেরে কারখানা-কর্তার গায়ে হাত তোলার কথা বললেন ভিন্ রাজ্যের এক শিল্পকর্তা।

মুখ্যমন্ত্রী এ দিনও পরিসংখ্যান দিয়ে দাবি করেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজ্য কতখানি এগিয়ে। কিন্তু শিল্পমহলের দাবি, লগ্নির পরিবেশ না-শুধরোলে, শুধু শুক্নো তথ্যে কাজ হবে না। প্রতিশ্রুতি যা-ই দেওয়া হোক, বাস্তবে তা কতখানি কার্যকর হচ্ছে, সেটাই দেখতে চাইবেন শিল্পপতিরা। তার জন্য শিল্পের অভাব-অভিযোগ আরও কান পেতে শুনতে হবে মুখ্যমন্ত্রীকে। কিন্তু সমস্যা হল, তাঁরা তো তা বলতেই ভয় পান! পাছে রাজরোষে পড়তে হয়। যেমন, এ দিনও প্রবেশ করের বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর সামনে তুলতে পুণের এক শিল্পকর্তাকে চাপাচাপি করছিলেন রাজ্যের শিল্পপতিরা। যাতে নিজেদের তা বলতে না হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mamata bandyopadhyay ficci
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE