সারদা কেলেঙ্কারি সামনে আসতেই পাততাড়ি গুটিয়েছিল রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি। তার পরেই বিপাকে পড়েছেন সংস্থাগুলির এজেন্টরা। টাকা ফেরত চেয়ে পাওনাদারদের তাগাদা তো রয়েইছে, মারধর-গালিগালাজও জুটছিল। এ সব দেখেই বাড়িছাড়া হয়েছেন অনেক এজেন্ট। বছর ঘুরতে গেলেও কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে রয়েছেন, কেউ বা পরিবারের সঙ্গেও তেমন যোগাযোগ রাখেন না।
আমানতকারী ধরে আনতে পারলেই মোটা কমিশন! এই ফাঁদে পড়েই অর্থলগ্নি সংস্থাগুলিতে এজেন্ট হিসেবে নাম লিখিয়েছিলেন গরিব বা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষগুলো। অনটনের সংসারে দু’পয়সা বেশি আয় কিংবা একটু ভাল থাকার ‘লোভেই’ সংস্থাগুলির এজেন্ট হয়েছিলেন তাঁরা। “শুরুর দিকে ভাল কমিশন মিলেছিল। আর্থিক অবস্থাও ফিরেছিল।”বলছেন বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্ট। কিন্তু সংস্থা বন্ধ হওয়ার পর আয় তো বন্ধ হয়েইছে, অনটনের সঙ্গে হাজির হয়েছে আতঙ্ক-সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাও।
কমিশনের আশায় পড়শি-পরিচিতদের তো বটেই, নিকটাত্মীয়দেরও বিনিয়োগ করিয়েছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলির এক এজেন্ট। সংস্থা বন্ধ হওয়ায় সেই পড়শি-পরিচিতেরাই বাড়িতে তাগাদা দিতে শুরু করেছিলেন। টাকা ফেরত অসম্ভব বুঝেই বৃদ্ধা মা-স্ত্রী-কোলের সন্তানকে ফেলে বাড়ি ছেড়েছিলেন ওই এজেন্ট। বছর ঘুরতে চললেও তিনি ফেরেননি। কোথায় আছেন, কেমন আছেন জানেন না পরিজনেরা। শুধু এখনও নিয়ম করে বাড়িতে আসে পাওনাদারেরা। তাদের রোষের মুখে পড়তে হয় অসুস্থ বৃদ্ধা আর তাঁর পুত্রবধূকে। ওই যুবকের এক আত্মীয় বলছেন, “টাকা ফেরত না পেলে আমরা কিছু বলব না। কিন্তু অন্যরা তা শুনবে কেন!”
অনেকটা একই অবস্থা দক্ষিণ বারাসতের এক মহিলা এজেন্টেরও। তিনি ও তাঁর স্বামী, দু’জনেই একটি অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্ট ছিলেন। সংস্থা বন্ধ হওয়ার পর থেকে স্বামী নিরুদ্দেশ। আমানতকারীদের হামলার ভয়ে বছর দেড়েকের সন্তানকে নিয়ে সারা দিন বাড়িতে থাকতে পারেন না ওই মহিলা। রোজ সকালে উঠে বেরিয়ে যান, সন্তানকে নিয়ে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে শুধু রাতটুকু কাটাতে বাড়ি ফেরেন।
বাড়ি ছাড়া না হলেও টাকা ফেরত দিতে না পেরে বন্ধু-পরিচিতদের এড়িয়ে চলেন উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরের এক এজেন্টও। টাকা রাখলেই প্রচুর সুদএই আশা দেখিয়ে ২০১১ সালে ছোটবেলার কয়েক জন বন্ধুকে নিজের সংস্থায় বিনিয়োগ করিয়েছিলেন তিনি। প্রথম দফায় এক বছর পর সুদসমেত আমানতের পর টাকা ফেরতও দিয়েছিলেন বিনিয়োগকারীদের। তার পরেই গত বছরের এপ্রিলে সামনে এল সারদা কাণ্ড। বিপদ বুঝে পাততাড়ি গোটালো ওই সংস্থাটিও। তার পরেই টাকা ফেরত চেয়ে বন্ধুদের ফোন পেতে শুরু করলেন তিনি। কখনও ‘দেখছি’, কখনও বা ‘মাস খানেকের মধ্যেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে’ বলে নিরস্ত করতেন বন্ধুদের। কিন্তু সেই সব আশ্বাস ধোপে টেঁকেনি। “বন্ধুরা হামলা করেনি। কিন্তু ওদের কাছে প্রতারক বলে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছি।”বলছেন মধ্য চল্লিশের ওই ব্যক্তি। বাড়ি ছাড়তে না হলেও পাড়ায় কিংবা পরিচিত মহলে কার্যত একঘরে হয়ে গিয়েছেন তিনি।
শুধু এজেন্টরা নন, রোষের মুখে পড়ছেন তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও। গালিগালাজ তো রয়েইছে, শারীরিক নিগ্রহের ঘটনাও বিরল নয়। গত বছরের মাঝামাঝি সোদপুরের এক অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্টের বাড়িতে চড়াও হয়েছিলেন এক দল আমানতকারী। এজেন্ট বা তাঁর স্ত্রীকে না পেয়ে পাকড়াও করা হয় বৃদ্ধ বাবা ও যুবক ভাইকে। পাড়ার ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে বেঁধে দিনভর ঝাঁটাপেটা করা হয় তাঁদের। রাতে ছাড়া পাওয়ার পর অপমান-দুঃখে ধুতির ফাঁস লাগিয়ে আত্মঘাতী হন ওই বৃদ্ধ। সেই ঘটনার পর আজও বাড়ি ফেরেননি ওই এজেন্ট বা তাঁর স্ত্রী।
শুধু এই ঘটনাই নয়, গত ক’মাসে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে আত্মঘাতী হয়েছেন ক’জন এজেন্টও। যে তালিকায় শেষ সংযোজন বীরভূমের সদাইপুরের বৈদ্যনাথ মিত্র। শুক্রবার সকালেই তাঁর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ সব ঘটনাই আরও চিন্তায় ফেলেছে এজেন্টদের পরিজনদের। কুলতলির ওই ফেরার এজেন্টের এক নিকটাত্মীয় বলছেন, “ও যেন ঝোঁকের মাথায় এমন কিছু করে না বসে।”
এই পরিস্থিতি এড়াতে বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্টরা মিলে একটি সংগঠন গড়েছেন। বিভিন্ন জেলায় এজেন্টদের হয়ে প্রচার করছেন তাঁরা। সংগঠনের পুরোধা ও প্রাক্তন নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমানতকারীদের টাকা ফেরত ও এজেন্টদের নিরাপত্তার জন্য আর্জি জানানো হচ্ছে। আত্মঘাতী এজেন্টদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের দাবিও জানানো হচ্ছে।” কিন্তু সে সবে রাজ্য প্রশাসন কান দিচ্ছে কি?
এটাই লাখ টাকার প্রশ্ন এজেন্টদের কাছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy