Advertisement
E-Paper

গল্পটা বাকি, শেষ করতে আসবি না তুই

এ তো আরতি মুখুজ্জে? না না সুমন কল্যাণপুর! ‘মনে করো আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে’—মেয়ের খাতায় গানের কথাগুলো চোখের কাছে ধরেন জয়া। প্রকাণ্ড পাঁচতলার ছাদ সুরে ভেসে যায়। গেল পুজোয় এই ছাদ ছেড়ে নামতে চাইত না মেয়ে। প্যান্ডেলে ফিতে কাটা আর জনে-জনে হ্যান্ডশেকের অত্যাচারে হাঁপিয়ে উঠেছিল। সই দেওয়ার ভয়ে, নীচে নিজের দোকানেও বসত না। একসঙ্গে তিনটে পুজোর মাইক ছাদে আছড়ে পড়ে। কোনার বাগপাড়ার মিলন সমিতি, পাইলটবাগান, অগ্রদূত। লিখছেন ঋজু বসু

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:১৫

এ তো আরতি মুখুজ্জে? না না সুমন কল্যাণপুর!

‘মনে করো আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে’--- মেয়ের খাতায় গানের কথাগুলো চোখের কাছে ধরেন জয়া।

প্রকাণ্ড পাঁচতলার ছাদ সুরে ভেসে যায়।

গেল পুজোয় এই ছাদ ছেড়ে নামতে চাইত না মেয়ে। প্যান্ডেলে ফিতে কাটা আর জনে-জনে হ্যান্ডশেকের অত্যাচারে হাঁপিয়ে উঠেছিল। সই দেওয়ার ভয়ে, নীচে নিজের দোকানেও বসত না।

একসঙ্গে তিনটে পুজোর মাইক ছাদে আছড়ে পড়ে। কোনার বাগপাড়ার মিলন সমিতি, পাইলটবাগান, অগ্রদূত। সেই বিশ্বকর্মা পুজো থেকেই চলছে... মেয়ের গানের খাতার পাতা উল্টোন মা।

কুতি কুতি অক্ষরের মিছিল। আধুনিক, নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত--- সবই তো শিখত। রুল টানা পাতার এ দিক থেকে ও দিক যত্নে ভরাট করা। ছোট থেকেই মেয়েটা এ রকম।

ডায়েরির পাতাতেও সেই যত্নের ছাপ। পাহাড়ে যখনই যেত সঙ্গী ডায়েরি। তারিখ মেনে লেখা নয়। এক পাতাতেই দু’-তিন দিনের রোজনামচা। গাদাগাদি করে ভরানো। ওর দাদা নেপালে গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার ডায়েরিটাও নিয়ে এসেছে। ওপরে ডায়েরি নিয়ে ওঠা যেত না। পাতা জুড়ে বেসক্যাম্পের দিনগুলোর খুঁটিনাটি। তখন শুধুই সামনে তাকিয়ে থাকা। অপেক্ষার প্রহর।

ওয়েদার রিপোর্ট বলছে, বুদ্ধ পূর্ণিমার পরে সব ক্লিয়ার থাকবে। মা দক্ষিণা কালী দেখিস আমায় এ বার! সামিটটা ভালয় ভালয় করিয়ে দিস!

জোড়া শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা ও ইয়ালুং কাং জিতে এলে দক্ষিণেশ্বরের কালীকে বেনারসী দেবে বলে এসেছিল মেয়েটা। তবু ফিরবে না?

অস্থির হয়ে ঠাকুরঘরে ঢোকেন জয়াদেবী। মা বেশি পুজো-আচ্চা করলে মেয়ে কিন্তু রেগে যেত। এখন বকার কেউ নেই। বড় ছেলে জ্যোতির্ময় নিরুপায় চোখে তাকান। “এই এক সমস্যা বুঝলেন! তেত্রিশ কোটি দেবতাকেও পারলে তেত্রিশ দিয়ে গুণ করবেন মা। কেউ বাদ নেই। পুজো শেষ না-হলে পেঁয়াজও ছোঁবেন না। সেই কোন্ সকালে যা চা-রুটি খেয়েছেন! বোন মিসিং হওয়ার পর থেকেই এমন চলছে।”

ফ্রেমে-বাঁধানো মানপত্র বা মেয়ের ঢাউস টেডি বিয়ারটার দিকে সস্নেহে তাকান মা।

...আসলে, বরাবরই আর পাঁচজন যা করে তার থেকে আলাদা কিছু করতে চাইত তো আমার মেয়ে! তাই বাকিরা যখন কাঞ্চনজঙ্ঘা ছুঁয়ে এসে বেসক্যাম্পের দিকে নামছে, ও দেখছিল নতুন এক শৃঙ্গের ছবি। এভারেস্টের সঙ্গে লোৎসে জিতে যেমন রেকর্ড করেছিল। তারও ছ’বছর আগে এক সঙ্গে পশ্চিম হিমালয়ের যোগী-এক ও তিন নম্বর শৃঙ্গ জয়ও তো রেকর্ড! এক ঢিলে দুই পাখি নিশানার নেশাটা তখন থেকেই চেপে বসে।

কাগজের লেখালেখি, পোড় খাওয়া পর্বতারোহীদের কথাগুলো মনে পড়লে হাসেন ছক-ভাঙা মেয়ের মা। অসম্ভবের স্বপ্ন দেখেছে, বলে এখন ওকেই দুষছে কেউ কেউ।

ডায়েরিতে ইংরেজিতে লিখে রেখেছিল, পাহাড় অভিযানের যত রকম বিধিনিষেধ। তাড়াহুড়ো, নার্ভাস হওয়া বা পাকামি নিয়ে পদে পদে সতর্কতা। তুষার বা পাহাড়ি পথের রকমফের নিয়ে বিস্তর জ্ঞান। নিজে ক্লাইম্বিংয়ের কোর্স করাত যে!

তবু কোথায় হারিয়ে গেল? কাঞ্চনজঙ্ঘা যে এভারেস্টের চেয়ে ঢের কঠিন, সে কি ও নিজে জানত না? কঠিন শৃঙ্গ জিতে এসে এক রাত্তির পেরিয়েই কেন রেকর্ড করতে ইয়ালুং কাং ছুঁতে বেরোল?

বারো বছর আগে কোরিয়া না কোথাকার একটা দল গিয়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার পশ্চিম শৃঙ্গে। তার পর আর কেউ না! অক্সিজেন, খাবার অঢেল থাকলেও অচেনা রাস্তায় দড়ির মাপটা ঠিক বোঝেনি ওরা। তা ছাড়া আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা-ই ছিল, ঝুঁকি আছে। হাতে আর আধখানা দিন... তার পর আবার ভয়ঙ্কর হাওয়া চলতে শুরু করবে।

তবু কেন গেল? জয়া বলেন, কেউ যেটা পারে না, সেটা পারার খিদেই তাড়িয়ে মারত ওকে!

হাওড়ার ব্যবসায়ী ঘরের মেয়ে। ইচ্ছে করলে বসে-বসে খেয়েই জীবনটা কেটে যেত। গান, সেলাই, রান্না পারত। পুঁচকে ভাইঝি মাম বলে, “পিসির মতো কচুরি, পনির, সিমুই তোমরা পার না!”

তবু সংসারের চেনা সমতল পোষাল না ওর।

গোড়ায় নিমরাজি থেকেও বিয়েটা করেছিল অবশ্য। কিন্তু অপমানের সহাবস্থানে মাথা হেঁট হয়ে থাকতে চাইল না কিছুতেই।

চারপাশের কদর্যতা থেকে বেরোতেই কি চিরতুষারের দেশকে এ ভাবে আঁকড়ে ধরল মেয়েটা?

ডিভোর্সের এক মাসের মধ্যেই পড়ি-মরি করে এভারেস্ট-অভিযান। তখন পাড়ার ক’টা ছেলে ওকে দেখলেই আওয়াজ মারে কী রে চল, বিয়ের গয়না বেচে এভারেস্টে বেড়িয়ে আসি!

ও কিছু বলত না, শুধু চোয়ালটা শক্ত হয়ে যেত।

স্পনসরের টাকা আর কতটুকু পেয়েছিল! নিজের গয়না, মায়ের জন্য বাবার রেখে যাওয়া টাকা, পলিসি-র সঞ্চয়--- সব ফাঁকা হয়ে গেল। ফেরত পেয়েছে এর ছিটেফোঁটা। এভারেস্ট থেকে ফিরতে কিন্তু সম্বর্ধনার ধুম লাগল। মেয়ে তখন ডায়েরিতে লিখছে, আমার রাজরানি মা আজ ভিখারি!

কাঞ্চনজঙ্ঘা ও ইয়ালুং কাংয়ের জন্য ৩৫ লক্ষ দরকার ছিল। গোড়ায় এক বর্ণ ইংরেজি বলতে হোঁচট খাওয়া মেয়ে স্পনসর ধরতে প্রাণপাত করে বেড়িয়েছে। ডায়েরির পাতাতেও সে-সবই লেখা---গুচ্ছের ঠিকানা, ফোন নম্বর। কবে, কার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। মেয়ে বাড়িতে থাকে না বলে, রাগ ধরে যেত। জয়া বলেন, “একবার বলেছিলাম, যা তবে পাহাড়েই থাক গে তুই! কেন বলেছিলাম?”

এখন ভাইঝিটা বলে, পিসি কবে আসবে? রাতে শুয়ে পাহাড়ের পাখিদের গল্প শুনব তো!

পাড়ার পুজোর ব্যানারে মেয়েকে দেখেন মা। চোখে চোখ পড়লে ভিজে যায় চোখ! ডায়েরির কুতি কুতি অক্ষরে হাত বুলিয়ে মেয়েকে আদর করেন মা। শেষ লেখা, ১৪ মে। বেসক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার পরে ধাপে ধাপে শৃঙ্গ জয়ের পরিকল্পনা। শেষ কথা, ‘অ্যাটেম্পট ইয়ালুং কাং।’

এর দিন সাতেক বাদেই এল কাঞ্চনজঙ্ঘা জয়ের খবর। তার কয়েক ঘণ্টা বাদে দুই শেরপা-সহ নিখোঁজ হওয়ার বার্তা। সত্যিই কি পা হড়কেছিল মেয়েটার? জয়া গায়েন বলে ওঠেন, “অভিযানের বাকি গল্পটা ডায়েরিতে লিখতে আসবি না তুই!’’

পুজোর গানে ভেসে যাচ্ছে দেবীপক্ষের ছাদ। “দুর্গার মতো তুইও তো পাহাড়েরই মেয়ে আমি জানি! ক’টা দিন পারিস না, এই মায়ের কাছে আসতে?”

শরৎ মেঘে মিশে থাকে অসম্ভবের স্বপ্ন। আকাশ থেকে নীচে তাকান শিখর-কন্যা! ছন্দা গায়েন।

pujo onyo pujo riju basu
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy