আত্মরক্ষার সেরা অস্ত্র হিসেবে আক্রমণকেই আপাতত আঁকড়ে ধরতে চাইছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তা করতে গিয়ে এ বারে ফের দলকে দিল্লির পথে নামাচ্ছেন আগ্রাসী মমতা।
সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের দিকে হাত বাড়ানোর পর থেকেই মমতা একাধিক বার কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে নিশানা করেছে। তাঁর নির্দেশে বিভিন্ন বিষয়ে সংসদের ভিতরে-বাইরে বিক্ষোভও দেখিয়েছেন তৃণমূলের সাংসদরা। সিবিআই রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্রকে গ্রেফতার করার পরে প্রবল চাপের মুখে বিরোধিতার সেই সুর আরও চড়িয়েছেন মমতা। মদনকে গ্রেফতারের পরের দিন তিনি নিজেই কলকাতায় বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন। কেন্দ্র-বিরোধিতার সুর তুঙ্গে নিয়ে যেতে এ বার ফের দিল্লিতে দলকে বিক্ষোভ দেখানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
আগামী কাল থেকে ফের শুরু হচ্ছে সংসদের অধিবেশন। তার ঠিক আগে সারদা-কাণ্ডে জেরবার তৃণমূলের রণকৌশল হল, সংসদের ভিতরে-বাইরে বিক্ষোভ দেখানো। দলের মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন, “বিজেপি ভোটের সময় অভিযোগ করেছিল সিবিআই-কে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তারাই এখন রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায়!” প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সামনে ধর্নায় বসারও কথা ভাবছে তৃণমূল। এখানেই শেষ নয়। বিজেপি এবং সিবিআই বিরোধিতার ডাক দিয়ে জেলায় জেলায় কর্মীদের ‘জেল ভরো’ আন্দোলনে নামার নির্দেশও দেওয়া হতে পারে বলে তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে।
মমতা কেন এমন কৌশল নিচ্ছেন? তৃণমূল মনে করছে, সারদা-কাণ্ডে যে ভাবে একের পর এক নেতা-সাংসদ ধরা পড়ছেন, তাতে মমতা অন্য সমস্যায় পড়েছেন। যে ভাবে কুণাল ঘোষকে সাসপেন্ড করা গিয়েছে, সে ভাবে ধরা পড়া সকলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এই মুহূর্তে মমতার পক্ষে কঠিন। কারণ সে সিবিআই তদন্তের জল শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, কারা ভবিষ্যতে দোষী সাব্যস্ত হবেন, সবই অজানার গর্ভে। ইতিমধ্যেই সারদা-কাণ্ডে মমতার দিকেও দুর্নীতির আঙুল উঠতে শুরু করেছে। যার মধ্যে বফর্স-কাণ্ডে রাজীব গাঁধীর ছায়া দেখছেন তৃণমূলের অনেকে। রাজীবের পরিণতি মাথায় রেখে মরিয়া মমতা তাই আক্রমণকেই আত্মরক্ষার অস্ত্র করছেন। এবং নিশানা করতে চাইছেন কেন্দ্রকে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহকে। বিজেপি বিরোধী প্রচারকে রাজ্য ছাড়িয়ে দিল্লিমুখী করার কৌশলও এর মধ্যে রয়েছে।
তৃণমূল সূত্রের খবর, দলের বিক্ষোভ-কর্মসূচি চলাকালীন এক দিনের জন্য হলেও দিল্লি আসতে পারেন মমতা। সেনা হাসপাতালে ভর্তি অসুস্থ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে দেখতেই তাঁর দিল্লি-যাত্রার সম্ভাবনা। কিন্তু তার পিছনে অন্য কারণও আছে। এই মুহূর্তে বিজেপি-বিরোধী যে সব মুখ্যমন্ত্রী বা দল এখনও মোদী-অমিত শাহের বিরুদ্ধে সে ভাবে সরব নয়, তাদেরও কাছে টানতে চান মমতা।
তাতে লাভ হবে কি? মমতা মনে করেন, বিজেপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে প্রচার চালালে তিনি রাজ্যে ‘ভিক্টিম স্ট্যাটাস’ পেতে পারেন। মমতা মনে করেন, গ্রাম বাংলার প্রায় শতকরা তিরিশভাগ সংখ্যালঘু ভোট তাঁর দিকে। বিজেপি-বিরোধী সুর চড়িয়ে এই ভোট ধরে রাখতে পারবেন। আর ওবিসি, তফসিলি-সহ নিম্নবর্গের ভোটাররা তাঁকে ছেড়ে বিজেপির দিকে যাবে না বলেই মত তৃণমূল নেত্রীর।
বিজেপির নেতারা অবশ্য মমতার রণকৌশল নিয়ে চিন্তিত নন। তাঁদের দাবি, যাঁকে গ্রেফতারের পরে মমতা এ ভাবে সরব হয়েছেন, সেই মদন মিত্র সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের একাংশের ধারণা অন্য রকম। তাঁরা মনে করেন, সারদার টাকা নয়ছয়ে মদন মিত্রের বড় ভূমিকা আছে ও মদন নিজে দুর্নীতিগ্রস্ত। এমন লোকের হয়ে পথে নামলে ভিন্ন বার্তা যাবে বলেই মনে করেন বিজেপি নেতারা। তাঁরা বলছেন, মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে মমতা যে ভাবে জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন, তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যে ভাবে প্রশ্ন উঠেছে, তাতে পথে নেমে লাভ হবে না। বিজেপির নেতা সিদ্ধার্থ নারায়ণ সিংহ বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের যে কোনও সাধারণ মানুষকে প্রশ্ন করুন। তারা কিন্তু বিশ্বাস করছেন, তৃণমূল নেতারা শুধু নন, মমতা নিজেও সারদার বড় সুবিধাভোগী।” একই কথা বিজেপি সভাপতি অমিত শাহেরও। তিনি বলেন, “রাজ্যবাসীর মোহ ভঙ্গ হয়েছে। যে পরিবর্তনের আশা মানুষ করেছিল, তা মমতা দিতে পারেননি।” সারদার সঙ্গে মমতার সম্পর্ক নিয়ে সরব হওয়ার পাশাপাশি তৃণমূলের জঙ্গি-যোগকে সামনে এনে প্রচার করতে চাইছে বিজেপি। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়দিবসে বিজেপি মুখপাত্র এম জে আকবর কলকাতা প্রেস ক্লাবে এই প্রসঙ্গ তুলে মমতাকে আক্রমণ করতে চলেছেন।
আগামী বছর থেকে রাজ্যে শুরু হচ্ছে নির্বাচনী মরসুম। কলকাতা এবং বিভিন্ন জেলা মিলিয়ে প্রায় শ’খানেক পুরসভার নির্বাচন হবে ২০১৫-য়। তার পরের বছর রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন। এই নির্বাচনী মরসুমে তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ হওয়ার দৌড়ে অন্যদের থেকে এগিয়ে বিজেপি। কংগ্রেস এবং সিপিএমও বুঝেছে, মমতা-বিরোধিতার পরিসর দখলের লড়াইয়ে তাঁরা কিছুটা পিছিয়ে। এটাকে কাজে লাগাতে মরিয়া বিজেপি। ঠেকাতে মরিয়া তৃণমূল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy