চেয়ার ছেড়ে এক সময় উঠে পড়লেন তিনি। বিচারকের সামনে গিয়ে করজোড়ে দাঁড়ালেন। পরনে হাল্কা বেগুনি রঙের হাফ হাতা পাঞ্জাবি। তার উপরে ঘিয়ে রঙের শাল। পায়ে লাল-কালো স্নিকার।
ইংরেজিতে বিচারককে বললেন, “স্যার! আমাকে ডাকা হয়েছিল। হাসপাতালে ছিলাম। বলেছিলাম, সুস্থ হলে আসব। দুর্ভাগ্যবশত কাল অসুস্থ অবস্থাতেই গিয়েছিলাম। সব কিছুই ঠিকঠাকই ছিল। আমাকে ডেকে সিবিআই যা যা প্রশ্ন করেছিল, আমি তার সব জবাব দিয়েছি।” নিজের হয়ে সওয়াল করছিলেন মদন গোপাল মিত্র। আদালতের খাতায় মদন গোপাল মিত্রই রাজ্যের পরিবহণ ও ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র। সারদা-কাণ্ডে যাঁকে শুক্রবারই গ্রেফতার করেছে সিবিআই।
আলিপুর আদালতে বিচারক কিংশুক সাধুখাঁর এজলাস এত ক্ষণ সরগরম ছিল তৃণমূলের সমর্থক আইনজীবীদের হট্টগোলে। সিবিআইয়ের আইনজীবী সেই হট্টগোলে কিছু বলতেই পারছিলেন না। অথচ সেই সময়েই এজলাসের মধ্যে কাঠগড়ার পাশে রাখা চেয়ার ছেড়ে মদন উঠতেই থেমে গেল শোরগোল।
গলায় সেই দাপট নেই। কী ভাবে শুক্রবার তাঁকে গ্রেফতার করা হল, স্তিমিত গলায় প্রতারণার মামলায় অভিযুক্ত মন্ত্রী সেটাই জানাচ্ছিলেন বিচারককে। বিচারকের উদ্দেশে মদন বলেন, “স্যার, আমি সিবিআইয়ের যুগ্ম-অধিকর্তা রাজীব সিংহের ঘরে ছিলাম। কিছু ক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে তিনিই আমাকে বলেন, ‘ঠিক আছে। আপনি এ বার পাশের ঘরে গিয়ে বসুন। চা খান। আপনার বিবৃতি নথিভুক্ত হয়ে গেলে আপনি চলে যেতে পারেন।’ আমিও ভাবলাম সিবিআই তা হলে আমার সঙ্গে কথা বলে সন্তুষ্ট। আমিও পাশের ঘরে চলে যাই। আমাকে চা দিয়ে যায়। বসে চা খাচ্ছিলাম। তখন এক অফিসার, তাঁকে আমি চিনি না, এসে বললেন, ‘স্যার, সরি। আপনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। দিল্লি থেকে নির্দেশ এসেছে।”
এটুকু বলেই তিনি বসে পড়েন চেয়ারে। তাঁকে তিন দিনের সিবিআই হেফাজতের নির্দেশ দিয়ে বিচারক এজলাস ছেড়ে যাওয়ার পরে মদনকে ঘিরে ধরেন অনুগামী আইনজীবী এবং আত্মীয়েরা। সেই ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসেন আদালত কক্ষের পিছনে বসে থাকা তাঁর স্ত্রী অর্চনা, পুত্রবধূ স্বাতী। স্ত্রীর হাতে হাত রাখেন মন্ত্রী। গলা নামিয়ে স্ত্রীকে বলেন, “বাইরে বেশ ভিড়। ঢোকা-বেরোনোর সময়ে ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে। তোমরা পারলে আমি বেরোনোর আগেই বেরিয়ে যাও।”
মদনের সামনে তখন আইনজীবীদের মধ্যে দাঁড়িয়ে বড় ছেলে স্বরূপ। তাঁর দিকে তাকিয়ে পরিবহণমন্ত্রী বলেন, “সত্যি বুঝতে পারিনি আমাকে গ্রেফতার করা হবে। তোকে ফোন করলাম না!” ছেলে পাল্টা বলেন, “হ্যা।ঁ ৩টে ৫৮-তে।” ঘনিষ্ঠ মহল জানাচ্ছে, মদন ওই ফোনে ছেলেকে বলেছিলেন, “আর বেশি দেরি হবে না। মনে হচ্ছে আধ ঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে যাব। আমি এখান থেকে বেরিয়ে সোজা সল্টলেক স্টেডিয়াম যাব। নীচে ড্রাইভারকে জানিয়ে দিস।” খবরও পেয়ে যান সেই ‘ড্রাইভার’। কিন্তু, কিছু ক্ষণ পরে জানতে পারেন, অন্য গাড়িতে করে থানায় নিয়ে যাওয়া হবে মন্ত্রীকে (ময়দানে গোষ্ঠ পালের মূর্তির সামনে সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রীও এ দিন এই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন)।
সে রাতে স্টেডিয়ামে বা বাড়িতে ফেরা হয়নি। শনিবার খারিজ হল জামিনের আর্জি। মদন ঠিক করেই নিয়েছিলেন, গ্রেফতারের কারণ জানতে চাইলে সংবাদমাধ্যমকে এ বার কী বলবেন তিনি। তাঁর কাছে যেতেই তাই বললেন, “এ বার আমাকে যা-ই জিজ্ঞাসা করবে, আমি শুধু ‘আই ডোন্ট নো’ (আমি জানি না) বলব।” ঠিক হয়, এখন কে কে তাঁর সঙ্গে সল্টলেকে ফিরবেন। আগামী দু’দিন তিনি যখন থানায় বা সল্টলেকে সিবিআই অফিসে থাকবেন, সেই সময়ে কারা আশপাশে থাকবেন তা-ও ঠিক হয়। যে পারিষদ, অনুগামীরা তাঁর চিরকালের ছায়াসঙ্গী, দু’দিন ধরে পালা দিয়ে তাঁরাই ঘোরাফেরা করবেন থানা ও সিবিআই দফতরের সামনে। এটা শুনেই স্বস্তি পেলেন মন্ত্রী। চোখেমুখে ফুটেও উঠল সেই ভাবটা।
অথচ, বেলা ৩টে ৫ মিনিটে আদালত কক্ষে ঢোকার সময় মুখ ছিল থমথমে। মন্ত্রীর আশঙ্কা ছিল, সিবিআই তাঁকে ১৪ দিনের জন্য হেফাজতে রাখার আবেদন করতে পারে। প্রায় পাঁচশো বর্গফুটের আদালত কক্ষে তত ক্ষণে অনুগামী আইনজীবী, সমর্থকেরা ঢুকে পড়েছেন। মদনের বাঁ হাতে ঘড়ি, ডান হাতের কব্জিতে পেঁচানো অনেকগুলো লালসুতো। পাট করে ব্যাকব্রাশ করা চুল। কামানো দাড়ি। দৃষ্টি শান্ত, পলকহীন।
আদালত কক্ষে ঢুকেই বাঁ দিকে দু’টি চেয়ারে বসানো হয় তাঁকে ও শুক্রবার ধৃত সারদার আইনজীবী নরেশ ভালোড়িয়াকে। ওকালতনামা সই করাতে আসেন এক আইনজীবী। মদন তাঁকে বলেন, ‘আমি নিজে কিছু বলতে চাই (বিচারককে)।’
ঘরটায় যথেষ্ট ভিড় থাকলেও হাল্কা ঠান্ডা। মাথার উপরে সব ক’টা পাখা ঘুরছে। ওই আইনজীবীর অনুরোধে ঘরের কোণে দাঁড়-করানো একটা পাখাও চালানো হয়। মন্ত্রীর দিকে ঘুরিয়ে। শুনানি শুরুর পর থেকেই শুরু হয় হট্টগোল। এজলাসে মদন কখনও হাত রেখেছিলেন বুকে। বিবেকান্দের ঢঙে। কখনও চেয়ারের হাতলে হেলান দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন আইনজীবীদের দিকে। পিঠ টানটান করে সোজা হয়ে বসে কড়ি-বরগার দিকে তাকিয়ে ছিলেন বেশ কিছু ক্ষণ। সওয়াল শেষ করে বসার পরের আধ ঘণ্টা কিন্তু অস্থির দেখিয়েছে মদনকে। কখনও মাথা নিচু করে কপালে হাত দিয়ে বসে ছিলেন। কখনও আবার সামনের দিকে চেয়ে পা নাচিয়ে গিয়েছেন। মাথা-যন্ত্রণা করলে কপাল চেপে ধরে যেমনটা করা হয়, অনেকটা সেই ঢঙে একটানা আঙুল বুলিয়ে গিয়েছেন কপালে। তর্জনীতে জ্বলজ্বল করছিল চুনি বসানো আংটি।
শুনানি শেষে তাঁকে ঘিরে থাকা আইনজীবীদের অনেককেই চিনতেন না। দলে তাঁর অনুগামী তৃণমূল নেতা আইনজীবী বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় পরিচয় করিয়ে দেন ওই আইনজীবীদের সঙ্গে। সেখানেও করজোড় মদন। মুখে সামান্য প্রশান্তির ছোঁয়া! এক আইনজীবীর ঘাড়ের উপর দিয়ে অন্য এক পরিচিত আইনজীবী প্রশ্ন ছোঁড়েন, “দাদা, সন্তুষ্ট তো!” তিন দিনের জন্য হাজতবাসের খবর শোনার পরেও যে তিনি সন্তুষ্ট, তা ঘাড় নেড়ে বুঝিয়েও দেন। কারণ, জামিন যে পাচ্ছেন না তা হয়তো বুঝেই গিয়েছিলেন মদন মিত্র। অনিন্দ্য রাউত নামে তাঁর অনুগামী এক আইনজীবী জানালেন, সিবিআইয়ের জেরার সময় মন্ত্রীর আইনজীবী উপস্থিত থাকতে পারবেন। মদনের আবেদনের ভিত্তিতেই বিচারক এই অনুমতি দিয়েছেন।
১৬ ডিসেম্বর ফের আদালতে হাজির করানো হবে পরিবহণমন্ত্রীকে। সে দিন জামিনের জন্য ফের আবেদন জানাবেন মদনের আইনজীবীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy