Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

জঙ্গি হোক বা পাচারকারী, নিরাপদ ডেরা শ্বশুরবাড়ি

পাচারের মতলবেই হোক বা জঙ্গি-যোগে, এ রাজ্যে ঢুকে ঘাঁটি গাড়া ভিন্ দেশিদের একাংশ অনায়াসেই দাবি করতে পারে, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’। বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে নিজেদের কাজ হাসিল করার মতলবে ভারতের সীমান্তের গ্রামগুলির দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের বিয়ে করছে পাচারকারী বা জঙ্গিরা। শ্বশুরকে বাবা বলে পরিচয় দিয়ে তৈরি করে ফেলছে ভোটার-কার্ড। যত দিনে জামাইয়ের স্বরূপ শ্বশুরবাড়ির লোকজন জানছেন, তত দিনে দেরি হয়ে যাচ্ছে।

গৌরব বিশ্বাস
করিমপুর শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৭
Share: Save:

পাচারের মতলবেই হোক বা জঙ্গি-যোগে, এ রাজ্যে ঢুকে ঘাঁটি গাড়া ভিন্ দেশিদের একাংশ অনায়াসেই দাবি করতে পারে, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’।

বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে নিজেদের কাজ হাসিল করার মতলবে ভারতের সীমান্তের গ্রামগুলির দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের বিয়ে করছে পাচারকারী বা জঙ্গিরা। শ্বশুরকে বাবা বলে পরিচয় দিয়ে তৈরি করে ফেলছে ভোটার-কার্ড। যত দিনে জামাইয়ের স্বরূপ শ্বশুরবাড়ির লোকজন জানছেন, তত দিনে দেরি হয়ে যাচ্ছে। যেমন অভিজ্ঞতা হয়েছে বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণে হত শাকিল গাজির শ্বশুরের। তবে তার পরেও নদিয়া-মুর্শিদাবাদের সীমান্তঘেঁষা বেশ কয়েকটি এলাকায় ঢুঁ মেরে শ্বশুরবাড়িকে কাজে লাগিয়ে নাগরিকত্ব জোগাড়ের এমন কিছু ঘটনা জানা গিয়েছে, যা অস্বস্তিকর।

সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের বাসিন্দা শাকিল নদিয়ার করিমপুরের বারবাকপুরে গিয়ে বিয়ে করে দুঃস্থ পরিবারের মেয়ে রাজিয়াকে। তার পরে শ্বশুরকে বাবা বলে পরিচয় দিয়ে তৈরি করে ভোটার কার্ড। খাগড়াগড়ের ঘটনার পর সীমান্ত রক্ষী বাহিনী, পুলিশ ও জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ) গোয়েন্দারা এ রকম অনেকেরই খোঁজ পেয়েছেন, যারা ওই একই কায়দায় ভোটার কার্ড তৈরি করেছিল।

কিন্তু কী ভাবে বাংলাদেশিরা এ পারে এসে পরিচয় ভাঁড়িয়ে বিয়ে করছে, আর কী ভাবেই বা তৈরি করে ফেলছে ভোটার কার্ড? নাম প্রকাশ না করার শর্তে করিমপুর ১ ব্লকের সীমান্তবর্তী এক গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য জানান, বাংলাদেশ থেকে যারা চোরাপথে এ পারে আসে, তাদের সঙ্গে এ পারের বহু লোকের সম্পর্ক থাকে। সেই সম্পর্কের খাতিরে বাংলাদেশ থেকে এখানে এসে বেশ কিছু দিন থাকায় অসুবিধা হয় না। কিন্তু কোনও কৌশলে এক বার ভারতের নাগরিকত্ব পেয়ে গেলে, সুবিধা অনেক। সে কথা মাথায় রেখেই বেছে নেওয়া হয় সম্ভাব্য পাত্রীর বাড়ি। বেশির ভাগ সময় এ পারে ওই বাংলাদেশির পরিচিতরাই ঘটকালি করেন। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতেই থাকার প্রতিশ্রুতি দেয় ওই বাংলাদেশি। দরিদ্র বাবা-মা-রা যাঁরা মেয়ের বিয়ে দেওয়া নিয়ে দুর্ভাবনায় ভোগেন, তাঁদের কাছে এই প্রস্তাব হাতে চাঁদ পাওয়ার সামিল। তাই অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে তাঁরা ওই বিয়েতে রাজি হন।

আর ভোটার কার্ড? ওই পঞ্চায়েত সদস্য জানান, প্রথমে ‘জামাই’ কত দিন এলাকায় আছে, সেটা দেখা হয়। এক জায়গায় (বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শ্বশুরবাড়িতে) ন্যূনতম ছ’মাস থাকার শংসাপত্র জোগাড় করে ফেলে ভিন্-দেশি জামাইরা। ভোটার তালিকায় নাম তুলতে এর পরেও লাগার কথা ‘বার্থ সার্টিফিকেট’ বা স্কুলের শংসাপত্র। ভোটার তালিকায় নাম তুলতে চেয়ে আবেদনকারীর এর কোনওটি না থাকলে, আবেদনকারীর বাবা-মা-র ভোটার তালিকার যে পাতায় নাম-ছবি রয়েছে, তার ফটো-কপি জমা দিতে হয়। সঙ্গে থাকে তাঁদেরই জবানে আবেদন ‘আমার ছেলে অমুক, তার বার্থ সার্টিফিকেট অথবা স্কুলের শংসাপত্র নেই। জন্মসাল এই। তার নাম ভোটার তালিকায় তোলা হোক’।

এনআইএ-র কাছে রাজিয়ার বাবা আজিজুল গাজি জানিয়েছেন, তাঁদের উপরে প্রভাব খাটিয়ে নিজেকে তাদের ছেলে বলে পরিচয় দিয়ে ওই মর্মে আবেদন করতে বাধ্য করেছিল শাকিল। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাতে রাজি হন তিনি। দিন কয়েক আগে মুর্শিদাবাদের ইসলামপুর থেকে পুলিশ এ রকম এক বাংলাদেশি জামাই আঙুর শেখকেও গ্রেফতার করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান কবুল করছেন, “পাত্র বাংলাদেশের। কিন্তু তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ও মেয়েটি তো এখানকার বাসিন্দা। তাই বিয়ে থেকে শুরু করে ভোটার কার্ডের বৃত্তান্ত জেনেও চুপ থাকি। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এলাকার মেয়েকে বিয়ে করেছে বলে আমাদের উপরেও চাপ থাকে।”

তবে এই প্রাক্তন প্রধান মানছেন, অন্য রকম চাপও রয়েছে। তাঁর দাবি, ভিন্ দেশি এই জামাইদের টাকার অভাব নেই। অনেকে অস্ত্র পাচারের সঙ্গেও যুক্ত। ফলে, স্থানীয় রাজনৈতিক মহলের একাংশে প্রভাব বিস্তার করতে তাদের সময় লাগে না। তাঁর কথায়, “টাকা আর অস্ত্র দিয়ে এরা স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা ও দুষ্কৃতীদের সঙ্গে এমন সম্পর্ক গড়ে যে, ‘জামাইয়ের ভোটার কার্ড হচ্ছে না কেন?’ বলে সে লোকগুলোই চাপাচাপি করে। সময়বিশেষে সে চাপের কাছে মাথা নোয়ানো ছাড়া উপায় থাকে না।”

এর পরেও ভিন্দেশি জামাইদের অনেকের শ্বশুরবাড়ির লোকের অভিজ্ঞতাই সুখকর নয়। মুরুটিয়ার ব্রজনাথপুরের বাসিন্দা এক প্রৌঢ়া যেমন। অভাবের সংসারে মেয়ের বিয়ে দিতে পারছিলেন না। গ্রামেই আসত পাচারকারী জামাই আলমগির শেখ। প্রৌঢ়ার মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় সে। বিয়ের পরে ঘরজামাই থাকা আলমগির পাচার-চক্রের নিজস্ব গণ্ডগোলের জেরে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর সামনেই খুন হয় শ্বশুরবাড়িতে। মুরুটিয়ারই পাকশিতে আর এক ভিন্দেশি জামাই রফিকুল শেখ আচমকা পালানোর পরে, শ্বশুরবাড়ি জানতে পারে, বাংলাদেশে রফিকুলের স্ত্রী-সন্তান রয়েছে। ততদিনে তাঁদের মেয়েরও দুই সন্তান হয়ে গিয়েছে।

করিমপুরের বারবাকপুরের বাসিন্দা শাকিলের শ্বশুর আজিজুল গাজিও জামাইয়ের ভোটার তালিকায় নাম তোলানোর পিছনের গণ্ডগোলটি স্বীকার করে নিয়ে এনআইএ-কে বলেছেন, “শাকিলকে বিশ্বাস করাটাই সব থেকে বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। এখন কী বিপদে পড়লাম বলুন তো!”

রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের মদতেই ভিন্দেশি জামাইদের রমরমা বেড়েছে বলে দাবি করিমপুরের সিপিএম বিধায়ক সমরেন্দ্রনাথ ঘোষের। তাঁর বক্তব্য, “বাম জমানাতেও ভিন্দেশিরা ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য ছক কষত। কিন্তু পঞ্চায়েত স্তরে বামফ্রন্টের প্রতিনিধিদের ফাঁকি দেওয়া সহজ ছিল না। এলাকায় ঘোরার সুবাদে কে কার ছেলে, কে কার জামাই তাঁরা জানতেন। তৃণমূলের জমানায় পয়সা-অস্ত্র দিয়ে অনেক কিছুই করা সম্ভব।” একই সুরে জেলা কংগ্রেস সভাপতি অসীম সাহার দাবি, “শাসক দলের কাছে ভোট-ব্যাঙ্কটাই বড় কথা। তাতে ভিন্দেশের ভেজাল মিশছে কি না, তা নিয়ে তারা আদৌ ভাবিত নয়।”

অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূলের জেলা নেতা তাপস সাহা। তাঁর বক্তব্য, “বিরোধীরা বিষয়টির সঙ্গে ভোট বা রাজনীতি জড়িয়ে ফেলছেন, যা ঠিক নয়। ভিন্দেশিদের এ ভাবে নাগরিকত্ব পাওয়ার ছক ভেস্তে দিতে আমরা গ্রামের মানুষকে বারবার সচেতন করছি। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। ভিন্দেশির সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে নিষেধ করলে উল্টে শুনতে হচ্ছে, ‘তা হলে মেয়ের বিয়ের দায়িত্ব তোমরা নাও’। এর পরে কী করা যায় বলুন!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

gaurab biswas karimpur terrorist in laws house
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE