Advertisement
০২ মে ২০২৪

জবাব কই, মানসের প্রশ্নেও চুপ শীর্ষ কর্তারা

নিজের মুখে তিন জনকে খুনের কথা কবুল করার পরেও লাভপুরের তৃণমূলের বিধায়ক মনিরুল ইসলামকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না? ওঁরা তিন জনের কেউই প্রশ্নের জবাব দেননি। বীরভূমের পাড়ুইয়ে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মীর বাবাকে খুনের ঘটনায় এফআইআর-এ নাম থাকা সত্ত্বেও কেন জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে না? ওঁদের কাছে মেলেনি সেই প্রশ্নের জবাবও।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৪ ০৩:০৪
Share: Save:

নিজের মুখে তিন জনকে খুনের কথা কবুল করার পরেও লাভপুরের তৃণমূলের বিধায়ক মনিরুল ইসলামকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না? ওঁরা তিন জনের কেউই প্রশ্নের জবাব দেননি।

বীরভূমের পাড়ুইয়ে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মীর বাবাকে খুনের ঘটনায় এফআইআর-এ নাম থাকা সত্ত্বেও কেন জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে না? ওঁদের কাছে মেলেনি সেই প্রশ্নের জবাবও।

কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে খুন-ধর্ষণে উস্কানি দিলেও পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল না কেন? রাজ্য প্রশাসনের তিন শীর্ষ কর্তা সে ব্যাপারেও মুখে রা কাড়েননি।

এ বার বামনগাছিতে প্রতিবাদী কলেজছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়েও যথারীতি কোনও বক্তব্য নেই রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডির!

রাজ্য প্রশাসনের এই তিন শীর্ষ কর্তার নিরবচ্ছিন্ন নীরবতা দেখে এ বার মুখ খুললেন কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইঞা। কার্যত রাজ্যের মানুষের মনের কথাকেই সামনে এনে সোমবার রাজ্য বিধানসভা চত্বরে মানস জানতে চাইলেন, “মুখ্যমন্ত্রী চুপ করে থাকতে পারেন, কারণ তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু কেন স্বরাষ্ট্রসচিব উত্তর দিচ্ছেন না? ডিজি শ্রীরেড্ডি কেন বলছেন না খুনি কোথায়? কার মদতে লুকিয়ে আছে? কেন চুপ রয়েছেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়?”

আমলারা সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলবেন কি না, সেটা একান্তই তাঁদের ইচ্ছা-নির্ভর। প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে তাঁরা বাধ্য নন। কিন্তু পাশাপাশি এটাও অস্বীকার করা চলে না যে, একের পর এক ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কী ব্যবস্থা নিচ্ছে তা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। মানসবাবুর দাবি, “ওঁরা (প্রশাসনিক কর্তারা) তো সকলে সাংবিধানিক পদে রয়েছেন। তবে কেন ওঁরা কোনও কথা বলবেন না? দোষীকে গ্রেফতার করা দূর অস্ত, বোবা-কালা-অন্ধ হয়ে বসে রয়েছেন ওঁরা।”

সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

প্রশাসনের একাংশের মতে, এই ভাবে বোবা-কালা হয়ে থাকাটাই তৃণমূলের জমানায় শীর্ষ কর্তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। নবান্ন থেকে এই রোগ ছড়িয়েছে প্রশাসনের নিচু তলা পর্যন্ত। কী রকম?

গত ৪ জুলাই লালবাতি লাগানো গাড়িতে চেপে দলীয় সভায় যোগ দিতে গিয়েছিলেন তৃণমূলের বীরভূম সভাপতি ও স্টেট রুরাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির চেয়ারম্যান অনুব্রত মণ্ডল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মোতাবেক অনুব্রত লালবাতি ব্যবহার করতে পারেন না। এ ব্যাপারে গত ১৯ জুন জারি করা রাজ্য সরকারের নির্দেশ প্রতিটি জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অথচ ওই অনুষ্ঠানে পুলিশ থাকা সত্ত্বেও তারা অনুব্রতর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।

প্রশ্ন করা হলে দেখা গিয়েছে, নবান্নের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের কোনও তফাৎ নেই। বীরভূমের জেলাশাসক বলেছেন, “কোনও মন্তব্য করব না।” রাজ্য প্রশাসনের একাংশ স্বীকার করছেন, এখন ‘মন্তব্য করব না’-রই যুগ চলছে। অতিভক্তি দেখাতে কোনও কোনও শীর্ষকর্তা এ-ও বলে দিচ্ছেন, তিনি যে মন্তব্য করবেন না বলেছেন, সেটাও যেন না লেখা হয়।

বিধানসভা চত্বরে মানস ভুইঁঞা এ দিন খোলাখুলি এ জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই দুষেছেন। বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী কলকাতাতেই রয়েছেন। বিধানসভাও চলছে। অথচ এত বড় নৃশংস হতা্যকাণ্ডের বিষয়ে একটা কথাও তিনি বলেননি।” তাঁর দাবি, মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় বিবৃতি দিন। সরকার কী কী পদক্ষেপ করছে তা জনগণকে জানানো হোক। মানসের পাশ থেকে এক বিরোধী দলের বিধায়ক ফুট কাটেন, “মুখ্যমন্ত্রীই বিধানসভাকে এড়িয়ে গিয়ে প্রশাসনের কর্তাদের কাছে পরিষ্কার বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন। তাই প্রশাসনের কর্তারা মূক-বধির হয়ে আছেন।”

মানসের এই তির্যক মন্তব্যের পরেও মুখ্যসচিব, রাজ্য পুলিশের ডিজি ফোন ধরেনিনি। এসএমএস-এর জবাবও দেননি। স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় কেবল ফোন ধরেছেন। কিন্তু সেই একই কথা, “আমি তো আগেই বলেছি, কোনও মন্তব্য করব না।” তা হলে মন্তব্য করবেন কে? বামনগাছির ঘটনায় জেলা পুলিশ খুনের রহস্য ভেদ করে ফেলেছে বলে সোমবার বিকেলে দাবি করেছে। জেলার পুলিশ সুপার সাংবাদিকদের কাছে মুখ খুলেছেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী কিংবা তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব চুপ। প্রশাসনের কর্তারাও নীরব। এক মাঝারি পুলিশ কর্তার টিপ্পনি, “ওঁরা জল মাপছেন। জল মাপাটাই এখন ওঁদের তিন জনের মূল কাজ।”

সত্যিই কি তাই? কারও কিছুই বলার নেই?

জনান্তিকে অনেক অফিসারই বলছেন, বলার বা করার অনেক কিছুই থাকে। কিন্তু সবার উপরে থাকে রাজনৈতিক চাপ, যার দ্বারা অফিসারেরা পরিচালিত হন। শুধু এই আমল নয়, সব আমলেই তা সত্য। অথচ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে না পারার জন্য বহু ক্ষেত্রে আদালতের ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয় অফিসারদেরই। আবার মুখ খুলে সরকারের বিরাগভাজন হলে শাস্তির খাঁড়াও নেমে আসে এই অফিসারদের উপরেই। কলকাতার পুলিশ কমিশনার আর কে পচনন্দা, আইপিএস অফিসার দময়ন্তী সেন বা স্বরাষ্ট্র দফতরের সাধারণ অফিসার বিস্ময় রায় তারই নমুনা।

যাঁরা সরকারের বিভিন্ন পদে রয়েছেন তাঁদের একাংশের বক্তব্য, শাসক দল কী চাইছে, সেটা বুঝেই সাধারণত অফিসারেরা প্রতিক্রিয়া দেখান। সরকার বেকায়দায় পড়তে পারে, এমন কিছু হলে বাম আমলেও প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা সেটা এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু একেবারে মৌনব্রত নেওয়ার দরকার পড়ত না। সরকারের বিরুদ্ধে কিছু না বললেও প্রশাসন কী করছে, সেই তথ্যটুকু জানানো হতো।

প্রশাসনের বর্তমান আধিকারিকদের একাংশই আড়ালে স্বীকার করছেন, এখন সবই নেত্রীর ইচ্ছায় কর্ম। তাঁর মন রেখেই অম্বিকেশ মহাপাত্র, শিলাদিত্য চৌধুরী, বা সুমন মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে পুলিশ-প্রশাসন অতি সক্রিয়তা দেখায়। অন্য দিকে লাভপুর-পাড়ুই-চৌমুহা-বামনগাছির ঘটনায় কর্তারা মুখে কুলুপ, কানে তুলো গুঁজে থাকেন! চেয়ার বা উর্দির ন্যূনতম সম্মানটুকুও রাখতে পারেন না। প্রশাসনের একাধিক অফিসারের করুণ মন্তব্য, পরিস্থিতি এখন খারাপ। স্রেফ কথা বললেই শাস্তি হতে পারে। শাস্তি মানে বদলি, শাস্তি মানে হেনস্থা।

অতএব, ‘নো কমেন্ট’।

চলছে চলবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE