জমি জটে ঠোক্কর খেয়ে তিন বছর গড়িয়েছে। সেই ফাঁস যদিও বা খুলল, এ বার কয়লার জোগান নিয়ে নতুন সঙ্কটে পড়েছে কাটোয়ার প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প।
বর্ধমানে কেন্দ্রীয় সংস্থা এনটিপিসি-র ওই প্রকল্পের জন্য কয়লা দেওয়ার কথা রাজ্যের। কিন্তু খনি বণ্টন কেলেঙ্কারি নিয়ে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের রায়ের জেরে আগামী ১ এপ্রিল থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের আওতাধীন ছ’টি খনির উপরে রাজ্য সরকারের আর কোনও অধিকার থাকছে না। সে ক্ষেত্রে, রাজ্য সরকার কোথা থেকে কয়লা দেবে, সেই প্রশ্নেই নতুন করে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
রাজ্য বিদ্যুৎ দফতরের কর্তারা এ নিয়ে মুখ খুলতে চাইছেন না। তবে দফতর সূত্রের খবর, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরেই এনটিপিসি রাজ্যের কাছে কয়লা জোগানের বিষয়টি নিয়ে জানতে চেয়েছে। সংস্থার এক কর্তার কথায়, “আমরা রাজ্য সরকারকে বলেছি, এ বিষয়ে গোড়াতেই আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। এই নিয়ে আমরা চিন্তায় আছি।” কর্তার ব্যাখ্যা, এই প্রকল্পে কয়লা পাওয়ার অন্য সূত্র তাঁদের নেই। এ ব্যাপারে তাঁরা রাজ্যের উপরেই পুরোপুরি নির্ভরশীল। কিন্তু রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম নিজেই যখন বিপাকে, তখন নিজেদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লার চাহিদা মিটিয়ে কী ভাবে তারা কাটোয়ায় কয়লা পাঠাবে, তার সদুত্তর মেলেনি।
রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা ছিল, বীরভূমে মহম্মদবাজার ব্লকে দেউচা-পাঁচামি নামে যে নতুন খনিটি তারা হাতে পেয়েছে, সেখান থেকেই কাটোয়া প্রকল্পের জন্য কয়লা পাঠানো হবে। কিন্তু সবে কাগজে-কলমে সেখানকার কাজ শুরু হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের পর কবে কোন সংস্থাকে দিয়ে কয়লা উত্তোলনের কাজ শুরু হবে, কোনও সরকারি কর্তাই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। ঠিক ছিল, যত দিন না ওই খনিতে কাজ শুরু হচ্ছে, তত দিন বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের নিজস্ব খনিগুলি থেকে কয়লা দেওয়া হবে, এমনটাও বলা হয়েছিল। কিন্তু গত মাসে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার হাতে থাকা দেশের মোট ২১৪টি কয়লা খনি বণ্টন বাতিল হয়ে যায়। তার মধ্যে এ রাজ্যের ৩০টি খনি রয়েছে। এর মধ্যে ছ’টি পাচোয়াড়া-উত্তর, বড়জোর, গঙ্গারামচক, গঙ্গারামচক-ভাদুলিয়া, তারা পূর্ব ও পশ্চিম ছিল পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের হাতে। ফলে রাজ্যের মোট উৎরাদনেও টান পড়তে চলেছে। আর সেটাই দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে এনটিপিসি কর্তাদের।
কাটোয়ার এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বিগত বাম আমলে প্রায় সাড়ে পাঁচশো একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু তৃণমূল ক্ষমতায় এসে আর কোনও জমি অধিগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় প্রকল্পটি ভেস্তে যেতে বসে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার ১০০ একর জমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এনটিপিসি অফিসারেরা বাকি জমির মালিকদের থেকে আগাম সম্মতিপত্র আদায় করে সরাসরি জমি কেনার বন্দোবস্ত করেন। ইতিমধ্যেই নির্মাণ সংস্থা হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্থা ‘দুসান’-কে বাছাই করে ফেলেছে এনটিপিসি। এত দিনের জট খুলে কাজে গতি আসায় সংস্থার কর্তৃপক্ষ থেকে জমিমালিক সকলেই যখন স্বস্তিতে, তখনই কয়লা সঙ্কটে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।
এনটিপিসি সূত্রের খবর, এ মাসের শেষেই সংস্থার পরিচালন পর্ষদের কাছে কাটোয়া প্রকল্পের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব পেশ করার কথা। তার আগে কয়লা নিয়ে এই ধরনের জটিলতা তৈরি হওয়ায় পর্ষদের সদস্যেরা নানা প্রশ্ন তুলতে পারেন। কেননা, কয়লার জোগান ও বিদ্যুৎ বিক্রির (পাওয়ার পার্চেজস এগ্রিমেন্ট) আগাম ব্যবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত না হলে ব্যাঙ্কগুলি ঋণ দেবে না। তা ছাড়া, এনটিপিসি-র মতো একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পক্ষে কোনও ফাঁক রেখে প্রকল্প নির্মাণে হাত দেওয়া উচিত নয়। সে ক্ষেত্রে, কাটোয়ার জন্য বিনিয়োগ-প্রস্তাব আপাতত পরিচালন পর্ষদের বৈঠকে না-ও পেশ করা হতে পারে।
নিগমের এক কর্তা অবশ্য এনটিপিসি-র এত চিন্তার কারণ দেখছেন না। তাঁর দাবি, কাটোয়া প্রকল্প শেষ হতে এখনও ঢের বাকি। তার অনেক আগেই খনি বণ্টন সমস্যা মিটে যাবে। ফলে কয়লা পাওয়া নিয়ে সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, “আমাদের আশা, ৩১ মার্চের আগেই কেন্দ্রীয় সরকার বাতিল খনিগুলির ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত নেবে। তা না হলে দেশ জুড়ে কয়লা তোলা এবং জোগানের পুরো ব্যবস্থাটিই ভেঙে পড়বে। ফলে এই সংশয়ও কেটে যাবে।”
কেন্দ্র যা-ই করুক, কয়লার অভাবে যদি প্রকল্পের ভবিষ্যৎ শিকেয় ওঠে, তার দায় রাজ্যও এড়াতে পারবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy