Advertisement
E-Paper

টেটও এ বার মোদীর অস্ত্র

গত সপ্তাহে ছিল সারদা। এ বার তার সঙ্গে রাজ্যে টেট-কেলেঙ্কারি এবং সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের প্রশ্ন তুলে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ত্রিফলা আক্রমণ শানালেন নরেন্দ্র মোদী। শ্রীরামপুরে এসে গত রবিবার সারদা-কাণ্ড নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে তুলোধোনা করেছিলেন বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। দলের দুই প্রার্থী সুভাষ সরকার ও বাবুল সুপ্রিয়ের সমর্থনে বাঁকুড়া ও আসানসোলে প্রচারে এসে এই রবিবার মোদী প্রধান হাতিয়ার করেছেন দুর্নীতিকেই।

সুশান্ত বণিক ও সুব্রত সীট

শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৪ ০৩:০০
কাছাকাছি। আসানসোলের সভায় নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়। ছবি:  সব্যসাচী ইসলাম।

কাছাকাছি। আসানসোলের সভায় নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।

গত সপ্তাহে ছিল সারদা। এ বার তার সঙ্গে রাজ্যে টেট-কেলেঙ্কারি এবং সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের প্রশ্ন তুলে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ত্রিফলা আক্রমণ শানালেন নরেন্দ্র মোদী।

শ্রীরামপুরে এসে গত রবিবার সারদা-কাণ্ড নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে তুলোধোনা করেছিলেন বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। দলের দুই প্রার্থী সুভাষ সরকার ও বাবুল সুপ্রিয়ের সমর্থনে বাঁকুড়া ও আসানসোলে প্রচারে এসে এই রবিবার মোদী প্রধান হাতিয়ার করেছেন দুর্নীতিকেই। সারদা-প্রশ্নে আক্রমণ বজায় রাখার পাশাপাশিই এ দিন তার সঙ্গে যোগ করেছেন রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় (টেট) দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগকে। মোদী রাজ্যে এসে তাঁকে আক্রমণ করে যাওয়ায় গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীকে ‘কাগুজে বাঘ’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। দুর্নীতিকে আড়াল করার অভিযোগের সূত্রেই এ দিন সেই কটাক্ষ ফিরিয়ে দিয়েছেন মোদী!

প্রথমে বাঁকুড়া এবং তার পরে আসানসোল, দু’টি সভাতেই এ দিন নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছু ক্ষণ পরে পৌঁছেছিলেন বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। কিন্তু দু’জায়গাতেই ঠাসা ভিড় তাঁর জন্য অপেক্ষায় ছিল। যা দেখে এক বিজেপি নেতার মন্তব্য, “আসানসোলে যেখানে ক’দিন আগেই তৃণমূল নেত্রীর সভা থেকে লোক চলে যেতে দেখা গিয়েছে, এ দিন সেখানে মোদীর সভা ঘিরে উন্মাদনা ছিল চোখে পড়ার মতো!” মোদীও এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন চতুর রাজনীতিকের কায়দায়। তাঁর মন্তব্য, “ভাবছিলাম, দিদি কেন আমার উপরে এত রেগে থাকেন! আজ এই ভালবাসা দেখে সেই রাগের কারণটা বুঝলাম!” তৃণমূল নেত্রীর প্রতি মোদীর আরও কটাক্ষ, “দিদি, এক বার একটু হেলিকপ্টারে ঘুরে যান! সব বাঘ এখানে জড়ো হয়েছে! এরাই রিয়্যাল টাইগার, রয়্যাল টাইগার!” দুপুরের এই কটাক্ষ শুনে তৃণমূল নেত্রী আবার বিকাল থেকে দু’টি সভায় গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীকে ‘কমরেড মোদীবাবু’ বলে পাল্টা বিঁধতে শুরু করেছেন! সিপিএম-বিজেপি’র সুর মিলে যাচ্ছে, এই কথা বোঝাতেই তাঁর এমন সম্বোধন!

মুখ্যমন্ত্রীর ছবি বিক্রি করে কত টাকা উঠেছে, কে কিনেছে, সেই প্রশ্নে এ দিন আর যাননি মোদী। তবে সারদার প্রসঙ্গে বলেছেন, “আপনার যদি হিম্মত থাকে, সারদা কেলেঙ্কারির প্রকৃত তদন্ত করান। বাঘ কখনও চোরদের আড়াল করে না!” বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থার রমরমা প্রসঙ্গে বাঁকুড়ার সভায় তাঁর আরও কটাক্ষ, “লক্ষ লক্ষ লোক শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর সরকার তালি বাজাচ্ছে!”

সারদার এই সূত্র ধরেই আসানসোলের সভায় টেট-কেলেঙ্কারির প্রসঙ্গ এনেছেন মোদী। এ রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ করে নিজের রাজ্য গুজরাতের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, গুজরাতে শিক্ষক নিয়োগের আবেদন জমা নেওয়া হয়েছিল অনলাইনে। তার পরে অনলাইন আবেদন থেকেই যোগ্যতা ও মান অনুযায়ী তালিকা তৈরি করা হয়েছে। বাড়িতে চাকরির চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হল। মোদীর কথায়, “দু’মিনিটের ইন্টারভিউয়ে কি সব কিছু বোঝা যায়? এখানে কিন্তু সেটাই হয়েছে। এটাই দুর্নীতির খেলা!” ইন্টারভিউ করলে দালাল আসে, পয়সা মেরে নেয়, বিধবা মায়ের ছেলেকে হয়তো চাকরি পেতে দু’লক্ষ-পাঁচ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয় দুর্নীতির বিষয়টি এই ভাবেই ব্যাখ্যা করে মোদীর প্রশ্ন, “টাইগার ভ্রষ্টাচারে ডুবে কেন?”

স্বচ্ছ ভাবমূর্তিকে মূলধন করে মমতার দল তথা সরকার যে এখন দুর্নীতির অভিযোগে জড়িয়ে পড়েছে, বারবার রাজ্যে এসে মোদীর মতো সর্বভারতীয় নেতা এই বিষয়টির উপরে জোর দিচ্ছেন। দুর্নীতিকে জড়িয়ে এমন আক্রমণের মোকাবিলা তৃণমূল নেত্রীকেও আগে কখনও করতে হয়নি। মোদী আরও চাপ বাড়ানোর পরে এ দিনই রানাঘাটে জনসভায় মমতা বলেছেন, “রাজ্যে আমরা ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত কী হয়েছে? কেন্দ্র কী করেছে? দিল্লিতে বিজেপি-ও ৬ বছর ক্ষমতায় ছিল। তারা কী করেছিল?” তাঁর আরও মন্তব্য, “এখন সব মনে পড়েছে! ভোটের সময় ইডি কাজ শুরু করেছে। সব জবাব দেবে মানুষ!”

শুধু মোদীই নন, সারদা তথা দুর্নীতি নিয়ে আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে বামেরাও। তমলুকে এ দিনই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সারদা-প্রসঙ্গে বলেছেন, “৬৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করলেন। কত লোকের টাকা আটকে আছে। কবে সেই টাকা উদ্ধার হবে? উত্তর চাইতে গেলে পুলিশ পাঠাচ্ছে!” এই সূত্রেই মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের লোকজনের সম্পত্তির প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, “আমাদের দলের নেতা গৌতম দেব এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু ওরা উত্তর দিতে চায় না। সেই রাতে পুলিশ তাঁর বাড়িতে গেল। আর এক নেতা সুজন চক্রবর্তীকেও নোটিস দিলেন।” হাসনাবাদে গিয়ে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারও বলেছেন, “সততার প্রতীক এখন দুর্নীতির প্রতীক! সারদার লুণ্ঠিত টাকায় হেলিকপ্টার উড়ছে! সিবিআই তদন্ত কেন হচ্ছে না? তা হলে সততার মুখোশ খুলে পড়বে!”

মোদী অবশ্য এ বার শুধু আক্রমণ নয়, উন্নয়নের প্রশ্নেও তৃণমূল নেত্রীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। ব্রিগেডে এসে দু’হাতে লাড্ডুর তত্ত্ব দিয়েছিলেন তিনি। তখন কোনও কোনও মহলে তাঁর সেই বক্তব্যের ব্যাখ্যা হয়েছিল তৃণমূলের সঙ্গে সন্ধির বার্তা হিসাবে। কিন্তু এ দিন বাঁকুড়ায় দু’হাতে রসগোল্লার তত্ত্ব এনে মোদী বুঝিয়ে দিয়েছেন, আসলে তিনি উন্নয়নের নিরিখে রাজ্যের মানুষের জোড়া ফায়দার কথাই বলতে চাইছেন। মোদী এ দিন বাঁকুড়ায় পরিষ্কারই বলেছেন, বাংলায় যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, দেশে সরকার গড়লে সেই রাজ্যের জন্য কাজ করা তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। মোদীর মতে, “দিল্লিতে মজবুত স্থায়ী সরকার হলে দিদিও সব নাটক বন্ধ করতে বাধ্য হবেন! ‘তু তু ম্যায় ম্যায়’ খেলা বন্ধ করতে হবে!” এর পরেই মোদীর মন্তব্য, “আমার কাছে ডব্ল ফায়দার ফর্মুলা আছে। আমার দু’হাতে রসগুল্লা আছে, চাই?” জবাবও দিয়েছেন “দিল্লির জন্য সব ‘কমল’ দিয়ে দিন। এমন কাজ করব যে, দিদিও ছুটতে বাধ্য হবেন। আমি একশো কিমি রাস্তা বানাব। তখন দিদিকেও ১০ কিমি বানাতে হবে! উন্নয়নের প্রতিযোগিতা হোক। দেখব, কে সাচ্চা টাইগার!”

তৃণমূল অবশ্য মোদীর উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ স্বীকার করার কথা সরাসরি না-বলে তাঁকে পাল্টা আক্রমণই করেছে। দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনের মন্তব্য, “ওদের বেলুন চুপসে গিয়েছে!” এক তৃণমূল নেতার কটাক্ষ, “দাঙ্গাবাজের সঙ্গে আবার কীসের প্রতিযোগিতা!” আর স্বয়ং তৃণমূল নেত্রীর কটাক্ষ, “পরের টাকায় পোদ্দারি! গুজরাতের চেয়ে সাধারণ মানুষের জন্য এ রাজ্যে বেশি কাজ হয়েছে।” একশো দিনের কাজের প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেছেন মমতা। অন্য দিকে, বামেরা মোদীর রসগোল্লা তত্ত্ব নিয়েও তির্যক প্রশ্ন তুলেছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর কথায়, “মোদী শক্ত থেকে নরম হয়েছেন। লাড্ডু থেকে রসগোল্লায় নেমেছেন! আমাদের মুখ্যমন্ত্রীকে এখন দিদি বলে সম্বোধন করছেন। আসল চেহারাটা বেরিয়ে পড়ছে!”

মোদী আবার এ দিন গুজরাতে সংখ্যালঘু উন্নয়নের তথ্য তুলে ধরে মমতাকে পাল্টা খোঁচা দিয়েছেন। তৃণমূল, কংগ্রেস বা বাম, ‘ধর্মনিরপেক্ষতার গান’ গেয়ে সকলেই যে সংখ্যালঘুদের প্রকৃত উন্নয়ন এড়িয়ে গিয়েছে, সে কথাই বোঝাতে চেয়েছেন মোদী। আসানসোলে তিনি বলেছেন, “দেখাতে পারি, গুজরাতে মুসলিমেরা যে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে, এখানে তার কিছুই পায়নি। আমি যে সংখ্যা দিচ্ছি, তা আমার নিজের নয়। সাচার কমিটির।” মোদীর পেশ করা তথ্য অনুযায়ী, গুজরাতে প্রাথমিক শিক্ষায় সুযোগ পেয়েছেন ৬০% মুসলিম, বাংলায় ৫০%। গুজরাতে গ্রামাঞ্চলে মাথা পিছু আয় ৭০০ টাকা, বাংলায় ৫০০ টাকা। শহরাঞ্চলের ক্ষেত্রে তা ৯০০ টাকা, বাংলায় ৭০০ টাকা। গুজরাতে মুসলিমদের ব্যাঙ্কে গড় সঞ্চয় ৩৫ হাজার টাকা। বাংলায় সেই গড় মাত্র ১১ হাজার টাকা। গুজরাতের জনসংখ্যায় মুসলিম ৮%। বাংলায় তা প্রায় ২৭%। কিন্তু গুজরাতে উচ্চ পদে মুসলিমদের নিয়োগের হার সাড়ে ৮%। যা বাংলায় মাত্র ১.২%। যার পরিপ্রেক্ষিতে মমতা রানাঘাটে পাল্টা বলেছেন, “সাচার কমিটির সুপারিশ মেনে সংখ্যালঘুদের উন্নয়ন করেছি। আরও করার পরিকল্পনা আছে।”

তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ও এ দিন শ্যামনগরের সভায় বলেছেন, “কেউই বলছে না, আমরা উন্নয়ন করিনি। আর কিছু বলার নেই বলেই সারদা নিয়ে পিছনে লাগার চেষ্টা করছে!” আর দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, “মোদীর আক্রমণ যতই বাড়ুক, পশ্চিমবঙ্গে মমতার জনপ্রিয়তার ধারেকাছে তিনি আসতে পারছেন না! মমতার কাজ ও নীতির ভিত্তিতেই মানুষ তাকে সমর্থন করবে।”

রাজ্যে আসতে পারেন রাহুল

রাজ্যে বারবার নরেন্দ্র মোদীকে প্রচারে এনে বিজেপি যখন ঝড় তুলতে চাইছে, কংগ্রেসও তখন বসে থাকতে রাজি নয়। এর মধ্যেই দু’দফায় প্রচার সেরে গিয়েছেন কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী। এ বার শেষ দফার ভোটের আগে ফের তাঁকে আনার চেষ্টায় প্রদেশ কংগ্রেস। প্রাথমিক ভাবে ঠিক আছে, ৭ বা ৮ মে রাহুল আসবেন কলকাতায়। মানস ভুঁইয়া যে কেন্দ্র থেকে লড়ছেন, সেই ঘাটালেও যেতে পারেন তিনি।

নীচের ছবিগুলি রবিবার পোলো ময়দানে শৈলেন সরকার ও সব্যসাচী ইসলামের তোলা।

modi bankura asasnsol susanta banik subrata sit
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy