Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

দুই রাজ্যে তফাত কত মালুম ওয়েবসাইটেই

কলকাতার ফুটবল লিগ আর স্পেনের লা লিগা। ধারে-ভারে এ দুয়ের যতটা মিল, ঠিক ততটাই মিল ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট’ আর ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এ! দুনিয়া জুড়ে প্রচার, লাগাতার বিজ্ঞাপন, কর্পোরেট হেভিওয়েটদের উপস্থিতি, বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা এ সব মাপকাঠি তো অনেক দূর। শিল্পমহলের মতে, স্রেফ দুই সম্মেলনের ওয়েবসাইট পাশাপাশি খুললেই তফাৎটা স্পষ্ট।

পশ্চিমবঙ্গের ওয়েবসাইটে দায়সারা পেজ।

পশ্চিমবঙ্গের ওয়েবসাইটে দায়সারা পেজ।

দেবপ্রিয় সেনগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১২
Share: Save:

কলকাতার ফুটবল লিগ আর স্পেনের লা লিগা। ধারে-ভারে এ দুয়ের যতটা মিল, ঠিক ততটাই মিল ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট’ আর ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এ!

দুনিয়া জুড়ে প্রচার, লাগাতার বিজ্ঞাপন, কর্পোরেট হেভিওয়েটদের উপস্থিতি, বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা এ সব মাপকাঠি তো অনেক দূর। শিল্পমহলের মতে, স্রেফ দুই সম্মেলনের ওয়েবসাইট পাশাপাশি খুললেই তফাৎটা স্পষ্ট।

দুই সাইটের শুরুটা একই রকম। রাজ্যে লগ্নির ঝুলি হাতে পা-রাখার আবেদন নিয়ে দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার পর আকর্ষণীয় ভাবে সাজানো তথ্যে ঠাসা গুজরাতের সাইট বহু যোজন পিছনে ফেলে দিয়েছে বাংলার ম্যাড়ম্যাড়ে ওয়েবপেজকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিল্পকর্তা বলছিলেন, “গুজরাতের পাশে ফেলে দেখলেই বুঝবেন পেশাদারিত্বের কত অভাব আমাদের সম্মেলনের সাইটে। যে রাজ্য কথায়-কথায় তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প নিয়ে গর্ব করে, তার দশা এমন হবে কেন? কেন মনে হবে যে, হাতের কাছে থাকা কিছু তথ্য তাড়াহুড়ো করে জড়ো করে গুঁজে দেওয়া হয়েছে ওয়েবসাইটে? কোথাও কোনও পরিকল্পনার ছাপ নেই!” আর এক শিল্পপতির কথায়, “গুজরাতের সাইটে উপচে পড়া তথ্য। সেখানে আমাদের শিল্প নিয়ে যেন কিছু বলারই নেই। যেন খেলতে নামার আগেই হাফ ডজন গোল হজম করে ফেলেছি আমরা!” অথচ সম্মেলনের প্রস্তুতির তত্ত্বাবধানে রয়েছেন অমিত মিত্র। যিনি শুধু শিল্পমন্ত্রী নন, বণিকসভা ফিকি-র পোড়খাওয়া প্রাক্তন শীর্ষ কর্তাও।

উৎপাদন শিল্প (কল-কারখানা), পরিকাঠামো এবং বিদ্যুৎ অর্থনীতির তিন স্তম্ভই রাজ্যের ‘ফোকাস এরিয়া’ বা আকর্ষণের কেন্দ্র হিসেবে সাইটে ঠাঁই পেয়েছে। কিন্তু তাদের নিয়ে খরচ করা হয়েছে সাকুল্যে কয়েকটি বাক্য। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, তবে কি রাজ্য মেনেই নিল যে, বড় কারখানা গড়তে এখানে কেউ আসেনি? বা অদূর ভবিষ্যতে আসার সম্ভাবনাও নেই? তাই শিল্পের মঞ্চে রাজ্যের কৃতিত্ব ঘোষণা করতে গিয়ে গিয়ে জানানো হয়েছে, আমরা ধান উৎপাদনে প্রথম, চা চাষে দ্বিতীয়। বলা হয়েছে কলকাতা-অমৃতসর শিল্প করিডরের কথাও। যা একে তো কেন্দ্রের প্রকল্প, তার উপরে কাজ এখনও শেষই হয়নি। শহরে নির্মাণ শিল্পে এই মুহূর্তে সুযোগ বলতে দু’একর জমির উপর স্কুল তৈরি।

বহু যোজন পিছিয়ে থাকার নমুনা ওয়েবসাইটের প্রযুক্তিতেও ভূরিভূরি। ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ সম্পর্কে জানতে স্মার্টফোনে তার ‘মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন’ (অ্যাপ) ডাউনলোড করলেই হল। এ রাজ্যের ঝুলিতে তা নেই। সম্ভাব্য লগ্নিকারী কারা, তাঁরা কী চান, কোথায় তাঁদের সংশয় ইত্যাদি জানতে বিশদ দু’রকম ফর্ম রয়েছে গুজরাতের সাইটে। সেখানে বাংলার সম্বল নাম-কে-ওয়াস্তে চারটি তথ্য জানতে চাওয়া একটি পেজ। কোথাও টাকা ঢালার আগে সেখানকার সরকারি নীতি, লগ্নির পরিবেশ ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদ জানতে চান লগ্নিকারীরা। গুজরাত তা সবিস্তার জানিয়েছে। আর বাংলার ওয়েবসাইটে বিভিন্ন শিল্প সম্পর্কে রাজ্যের নীতির (পলিসিস অ্যান্ড স্কিমস) পেজটি খুলতেই বেগ পেতে হচ্ছে বিস্তর। হোটেলের খোঁজ বলতে সাদা কাগজে শহরের বিভিন্ন পাঁচতারা হোটেলের ভাড়া আর সুযোগ-সুবিধার তালিকা।

তিন বছরে ৮৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ টানার কথা সেই কবে থেকে হন্যে হয়ে প্রচার করে যাচ্ছেন অমিত মিত্র। ওয়েবসাইটেও সেই দাবি সম্বলিত খবরের কাগজের কাটিংয়ের ছবি রয়েছে। কিন্তু নতুন বিনিয়োগ কোথায় এল কিংবা কারা সেই টাকা ঢালল, তার হদিস নেই। গুজরাত যেখানে এই সম্মেলন নিয়ে তাদের সমস্ত প্রচার কর্মসূচি (রোড শো, সেমিনার ইত্যাদি) ওয়েবপেজে তুলে দিয়েছে, সেখানে রাজ্যের সবেধন নীলমণি মুখ্যমন্ত্রীর সিঙ্গাপুর সফর! সম্মেলনে বক্তা ও আমন্ত্রিত প্রতিনিধি কারা, আগের দিন সন্ধে পর্যন্ত তা জানার জো নেই। এক শিল্প কর্তা বলছিলেন, “হয় শেষ মুহূর্তের জন্য কোনও চমক তুলে রাখা রয়েছে। আর নইলে তেমন কেউ আসছেনই না।”

ওয়েবসাইটে গুজরাত টানা দেখিয়ে চলেছে, কোন ক্ষেত্রে ক’টি সমঝোতা পত্র সই হতে পারে। আসতে পারে কত লগ্নি। সেখানে বঙ্গ-সাইট এ বিষয়ে নিশ্চুপ। রাজ্যেরই এক শিল্পকর্তার কটাক্ষ, “এখানে লগ্নি বা তার সম্ভাবনা কোথায়? আপডেট দিতে হলে তো সিন্ডিকেট আর তোলাবাজির তালিকা ঝোলাতে হয়!”

যে কোনও পণ্য বা পরিষেবা বেচতে হলে তার বিপণন কৌশলও সঠিক হওয়া জরুরি। পর্যটন প্রসারে এই আপ্তবাক্য মেনে সাফল্যের মুখ দেখেছে কেরল। শিল্প সম্মেলনের ওয়েবসাইট তৈরির সময় তা অক্ষরে অক্ষরে মেনেছে গুজরাতও। কলকারখানায় লগ্নিতে পছন্দের গন্তব্য হয়ে ওঠার পর এ বার তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে পাখির চোখ করছে তারা। সাইটের শুরুতেই তা স্পষ্ট। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের ওয়েবসাইটে যেন তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কিছু বলারই নেই! সেই তথ্যপ্রযুক্তি, যা তবুও টিমটিম করে জ্বলছে এ রাজ্যে। বিনিয়োগের পক্ষে পশ্চিমবঙ্গ কেন ভাল, তা বোঝাতে সেই চর্বিতচর্বণ। যা দেখে অনেকেই বলছেন, “নতুন আর ভাল ঘটেছে কী, যা ফলাও করে লেখা যাবে?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE