Advertisement
০৩ মে ২০২৪

দু’কক্ষে দুই নীতির চাল হোঁচট খেল বিতর্কে

কে বড় শত্রু? বিজেপি, সিপিএম না কংগ্রেস? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে যে এই প্রশ্নটি রয়েছে, তা আজ সংসদের দুই কক্ষে তৃণমূলের দু’রকম আচরণে স্পষ্ট হয়ে গেল। সিপিএমের রাজনীতিতে কংগ্রেস না বিজেপি কে বড় শত্রু এই দোলাচল দীর্ঘ দিনের। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির অভূতপূর্ব উত্থান দেখে মমতার রাজনীতিতেও যেন সেই একই দোলাচল!

কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৪ ০৩:৩২
Share: Save:

কে বড় শত্রু?

বিজেপি, সিপিএম না কংগ্রেস?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে যে এই প্রশ্নটি রয়েছে, তা আজ সংসদের দুই কক্ষে তৃণমূলের দু’রকম আচরণে স্পষ্ট হয়ে গেল।

সিপিএমের রাজনীতিতে কংগ্রেস না বিজেপি কে বড় শত্রু এই দোলাচল দীর্ঘ দিনের। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির অভূতপূর্ব উত্থান দেখে মমতার রাজনীতিতেও যেন সেই একই দোলাচল! গত কাল নবান্নে সিপিএম নেতাদের সঙ্গে ‘ফিশ ফ্রাই কূটনীতি’র পর আজ তাই লোকসভায় কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুলতান আহমেদের নেতৃত্বে তৃণমূলের ঘোরতর মোদী বিরোধিতা দেখে বিজেপি শীর্ষ নেতারা কিন্তু বিস্মিত হচ্ছেন না। আবার লোকসভায় জঙ্গি বিরোধিতা এবং ব্যক্তি আক্রমণের নজির রাখলেও সেই একই তৃণমূল কিন্তু রাজ্যসভায় ডেরেক ও’ব্রায়েনের নেতৃত্বে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে হেঁটে সহযোগিতামূলক রাজনীতির নজির গড়ল।

তবে কি লোকসভা-রাজ্যসভা, এই দু’কক্ষে দু’মুখো রণকৌশল নিয়েছে তৃণমূল? একেই কি বলে নরম-গরম রাজনীতি?

তৃণমূল সূত্র বলছে, চিত্রনাট্য সে রকমই ছিল। একই সঙ্গে গঠনমূলক সহযোগিতার বার্তা দেওয়ারও কথা ছিল। কিন্তু কলাকুশলীদের অতিনাটকীয়তাই পরিস্থিতি বিগড়ে দিয়েছে! গোটা ঘটনায় কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে ক্ষুব্ধ তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। তাঁদের বক্তব্য, সরকারের সঙ্গে গঠনমূলক সহযোগিতার বার্তাও দিতে বলা হয়েছিল দলের দুই কক্ষের সাংসদদের। রাজ্যসভায় তা মানা হলেও লোকসভায় কল্যাণের দৌলতে ভেস্তে গিয়েছে!

এ দিন রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা-বিতর্কের শুরুতেই কল্যাণ সরকার শিবিরকে আক্রমণ করতে থাকেন। সমালোচনা করেন মোদীরও। এ সময় আন্দামানের বিজেপি সাংসদ বিষ্ণুপদ রায় সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে প্রশ্ন তুললে কল্যাণ পাল্টা বলেন, “অদানি ও অম্বানীরা মোদীকে প্রচারে কত টাকা দিয়েছেন?” বিচারব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে বলতে গিয়ে জেটলিকে ব্যক্তিগত আক্রমণও করে বসেন কল্যাণ। তিনি বলেন, “সরকারের উচিত প্রতিটি রাজ্যে সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ খোলা। তবে অরুণ জেটলি আমার বক্তব্যে সহমত নাও হতে পারেন। তা ছাড়া জেটলিকে তো আর লোকসভায় জিতে আসতে হয়নি!” এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বিজেপি নেতা অনন্তকুমার বলেন, “জেটলি এই মুহূর্তে লোকসভায় নেই। সুতরাং তাঁর নামে কিছু বলা অনুচিত। তা ছাড়া তিনি রাজ্যসভার সাংসদ।” শাসক দলের প্রতিবাদের পরে জেটলি সংক্রান্ত বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন কল্যাণ।

রাজ্যসভায় তৃণমূল নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন কিন্তু অন্য বার্তা দিচ্ছেন। রাজ্যসভায় ডেরেক গঠনমূলক বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “রাজ্য সরকারগুলিকে বন্ধু ভাবুক কেন্দ্র। কেন্দ্র যেন উপর থেকে কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা না করে। কেন্দ্র যদি আমাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করে, তা হলে আমরাও সরকারকে বিপদে ফেলব না।” একই সঙ্গে তিনি বলেন, “সরকার যদি ভাল কাজ করে, তা হলে সমর্থন করব।” রাজ্যের আর্থিক দাবিদাওয়া পূরণে কেন্দ্রকে সক্রিয় হতেও অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।

লোকসভায় কল্যাণের মন্তব্যের পরেও জেটলি কিন্তু কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী হিসেবে রাজ্যের প্রতি সহযোগিতারই বার্তা দিয়েছেন। গত কাল রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে অমিত মিত্রকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন জেটলি। আজ তিনি বলেন, “তৃণমূলের কোনও সাংসদ আমায় ব্যক্তিগত ভাবে আক্রমণ করল কি না, তার ভিত্তিতে আমরা কোনও যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণ করছি না। কেন্দ্র-রাজ্য সাংবিধানিক সম্পর্ক রক্ষার প্রশ্নে আমরা দায়বদ্ধ।”

কল্যাণের এ দিনের আচরণের একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছেন ডেরেক। তাঁর কথায়, “লোকসভায় রাজীবপ্রতাপ রুডি সরকার পক্ষের হয়ে বলতে গিয়ে তৃণমূলকে অনর্থক আক্রমণ করেন। সেই প্ররোচনারই প্রতিফলন লোকসভায় তৃণমূল সাংসদদের মধ্যে ফুটেছে। রাজ্যসভায় এ ধরনের কোনও প্ররোচনা ছিল না। তাই কোনও সংঘাত হয়নি।”

কী ‘প্ররোচনা’ দিয়েছিলেন রুডি?

রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা-বিতর্কে প্রথমে বলতে উঠে বিগত সরকারের অন্যান্য মন্ত্রকের মতোই রেল মন্ত্রকের কাজকর্মের সমালোচনায় সরব হন রুডি। তিনি বলেন, “ইউপিএ আমলে রেল মন্ত্রকের অবস্থা এমনই ছিল যে এক জন রেলমন্ত্রী বাজেট পেশ করার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হয়!” নাম না করে তৃণমূল সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদীর কথাই বোঝাতে চেয়েছেন রুডি। স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিবাদ করে তৃণমূল শিবির। পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন নিয়েও প্রশ্ন তোলেন রুডি। বিজেপি যে পশ্চিমবঙ্গ নিয়েও আক্রমণাত্মক হচ্ছে, তা স্পষ্ট হয়ে যায় তৃণমূলের কাছে। বাংলা নিয়ে নিজেদের অবস্থান বোঝাতে বিজেপি আরও একটি পদক্ষেপ করেছে। সদ্যই তাদের একটি কেন্দ্রীয় দল পশ্চিমবঙ্গে ঘুরে যাওয়ার পরে ফের মোক্তার আব্বাস নকভির নেতৃত্বে একটি দলকে রাজ্যে পাঠানোর কথা ভাবছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। আজকের ঘটনার পরে বিজেপির অনেকেই মনে করছেন, তাঁদের আক্রমণাত্মক মনোভাব দমিয়ে দিতেই তৃণমূল লোকসভায় এমন আচরণ করেছে। এই পরিস্থিতিতে বিজেপিও তৃণমূলকে পাল্টা চাপে রাখার চেষ্টা বাড়াতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।

মমতার সঙ্গে শীর্ষ বাম নেতাদের বৈঠক দেখে বিজেপির মনে হচ্ছে যে, বাংলায় তাদের শ্রীবৃদ্ধি নিয়ে তৃণমূল আতঙ্কিত। লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১১ শতাংশ ভোট বেড়েছে বিজেপির। খোদ কলকাতায় ২৬টি ওয়ার্ডে এগিয়ে রয়েছে তারা। সামনেই একাধিক পুরসভার নির্বাচন। ফলে বিজেপির এই শক্তিবৃদ্ধিতে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন তৃণমূল নেত্রী। আর সেই পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি আরও আক্রমণাত্মক হচ্ছেন।

অন্য দিকে জেটলির মাধ্যমে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক অটুট রাখতে চাইলেও রাজ্যস্তরে শাসক দলের সঙ্গে কোনও আপসের রাস্তায় যেতে চান না মোদী। অনেকেই মনে করছেন, অতীতে জাতীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় সিপিএমের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে রাজ্য কংগ্রেসের যে শক্তিহ্রাস হয়েছিল, ক্ষমতায় এসে সেই পথে হাঁটতে চাইছেন না বিজেপি নেতৃত্ব। বরং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রাজ্যে দলের শক্তি বাড়াতেই উৎসাহী তাঁরা।

এ দিন কল্যাণের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ মোদী-জেটলিরা। তাঁরা ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, যখন সরকারের নেতারা পশ্চিমবঙ্গকে অর্থ সাহায্যের জটিলতা দূর করতে সক্রিয়, তখন তৃণমূলের এমন আচরণ ঠিক নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kalyan bandyopadhyay parliament policy tmc
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE