Advertisement
E-Paper

দু’টাকার চালেও টান, বিনা বাধায় গ্রামে ঢুকছে বনপার্টি

লাল মাটিতে মাওবাদী হিংসা বন্ধ প্রায় তিন বছর। তা বলে কি মাওবাদীদের আনাগোনাও নেই! লালগড় আন্দোলন ছ’বছর পূর্ণ হওয়ার মুখে জঙ্গলমহল সত্যিই হাসছে কি না, সরেজমিনে দেখল আনন্দবাজার।কিস্তিমাত করে দেওয়া চালেও এ বার গলদ আর ফাঁকি! একের পর এক নির্বাচনী লড়াইয়ে তৃণমূলের কাছে পর্যুদস্ত জঙ্গলমহলের সিপিএম নেতাদের অনেকেই একটা কথা কবুল করেন খোলাখুলি। কথাটা হল, এ তল্লাটের ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের মধ্যে ২ টাকা কেজি দরে চাল বিলির সিদ্ধান্ত নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোক্ষম চাল দিয়েছেন।

সুরবেক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৫৭

কিস্তিমাত করে দেওয়া চালেও এ বার গলদ আর ফাঁকি!

একের পর এক নির্বাচনী লড়াইয়ে তৃণমূলের কাছে পর্যুদস্ত জঙ্গলমহলের সিপিএম নেতাদের অনেকেই একটা কথা কবুল করেন খোলাখুলি। কথাটা হল, এ তল্লাটের ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের মধ্যে ২ টাকা কেজি দরে চাল বিলির সিদ্ধান্ত নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোক্ষম চাল দিয়েছেন। আর এতেই কিস্তিমাত হয়ে গিয়েছে মূলস্রোতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির তো বটেই, এমনকী মাওবাদী ও তাদের সমর্থকদেরও। আর কিছু জুটুক না জুটুক, এই সিদ্ধান্তের জেরে মানুষের অভুক্ত থাকার কথা নয়। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা, যা মিটলে অন্য অনেক ব্যথার উপশম হয় আপনা-আপনি। তাই, শুধু শাসক দলের নির্বাচনী সাফল্য নয়, গত তিন বছর যাবৎ জঙ্গলমহল হিংসামুক্ত থাকার বড় কারণ যে এই চাল বিলি, সেটাও বিরোধীদের একটা বড় অংশ একবাক্যে মেনে নেন।

কোনও কোনও অঞ্চলে একশো দিনের কাজ নেই, কোথাও একশো দিনের কাজ হয়েছে তো ছ’-সাত মাস ধরে মজুরির দেখা নেই, সেচের ব্যবস্থা না থাকায় ফলন নেই এই অবস্থায় রুক্ষ-শুষ্ক মাটির জঙ্গলহলের দীনদরিদ্র মানুষের মধ্যে ওই চাল বিলি প্রায় হাঁপানি রোগীকে নেবুলাইজার দেওয়ার মতো। যা মানতে দ্বিধা নেই আড়শার বাড়িয়াডি গ্রামের লাল্টু মাণ্ডি ও বৈদ্যনাথ মাঝি, হেরোডি গ্রামের বিপ্লব মুর্মু ও প্রেমচাঁদ টুডুদের। এমনকী, একশো দিনের কাজ ও ইন্দিরা আবাসের ঘর নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে শাসক দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়া মুদালি গ্রামের রাজেশ কর্মকার ও মেঘনাদ মণ্ডলও বলছেন, “জীবনটা বেঁচে আছে ওই ২ টাকা কেজি চালের জন্য। মাড়ভাত-নুনের তো অভাব হচ্ছে না।”

কিন্তু সেই অভাবও এ বার দেখা দিচ্ছে কোনও কোনও এলাকায়। মূলত সেই সব জায়গায়, যে সব জায়গার সঙ্গে যোগাযোগ দুরূহ। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি সপ্তাহে প্রাপ্তবয়স্কদের মাথা পিছু ২ কেজি ও ছোটদের মাথা পিছু ১ কেজি চাল পাওয়ার কথা। কিন্তু পাচ্ছেন অনেক কম। অযোধ্যা পাহাড়ের উপরে থাকা ভুদা গ্রাম যেমন এই প্রতারণার শিকার। গ্রামে ঢোকার পথ দু’টি। একটিতে পেরোতে হবে বাঁদু ও অন্যটিতে পড়বে ভুরভুরিয়া নদী। অথচ কোনওটিতেই সেতু দূরের কথা, সাঁকো পর্যন্ত নেই। কখনও হাঁটু, কখনও কোমর জল পেরোতে হয়। বর্ষায় হড়পা বানে ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা। গাড়ি নিয়েও লাভ নেই। নদী পেরোনোর পরে এক কিলোমিটারের পুরোটাই খন্দপথ। শিরকাবাদ অঞ্চলের ওই আদিবাসী গ্রামের উমেশ লায়া, বাবলু মুড়ারা জানালেন, কোনও কোনও সপ্তাহে প্রাপ্তবয়স্করা চাল পাচ্ছেন মাথা পিছু দেড় কেজি, কখনও এক কেজি। আর নাবালক-নাবালিকাদের জন্য বরাদ্দ পাঁচশো কিংবা সাড়ে সাতশো গ্রাম।

আবার বেলপাহাড়ির শিমুলপাল অঞ্চলের পাথরচাকরি গ্রামের লাল্টু কর্মকার, ক্ষুদিরাম মুর্মুদের বক্তব্য, “কোনও কোনও সপ্তাহে গ্রামের কেউ এক দানা চালও পাচ্ছে না। পরেও সেই চাল মেটানো হচ্ছে না।” বোধহয় এই প্রেক্ষাপটেই শ্রীজন হেমব্রম সতর্ক করে দেন, “বনপার্টিকে এখন দেখা যাচ্ছে না বটে, তবে ওরা কিছু দিনের মধ্যে ফেরত আসতেও পারে!”

আর এমন প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত-টিঙ্গিত নয়, বাঘমুণ্ডির পারডি চিরুগোড়া গ্রাম সাফ জানাচ্ছে, এই ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম হলে মাওবাদী দাওয়াই-ই অব্যর্থ। রঞ্জিত মাহাতো, বলদেব সরেনদের কথায়, “কই, মাওবাদীরা তো আমাদের মারেনি! আসলে যাদের ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল, তাদেরই মেরেছে মাওবাদীরা। আবার সেই দুর্নীতি শুরু হয়েছে। এখনই সামলে না গেলে তারা আগের মতোই শাস্তি পাবে!” এই গ্রামেই ২০১০-এর ৩ অক্টোবর তিন জনকে এক সঙ্গে হত্যা করেছিল মাওবাদীরা। নিহতদের অন্যতম গ্রামের রেশন ডিলার দশরথ মাঝি। ডিলারশিপ পরে হস্তান্তরিত হয় নিহতের স্ত্রীর নামে। মদনমোহন মাহাতো বলেন, “বিডিও অফিসে দেখানোর জন্য ডিলারের কাছে ক্যাশমেমো চেয়েছিলাম। দিতে রাজিই হল না।” হাতুয়াল গ্রামের মথুর মাঝি বলেন, “হাসিমুখ-টুখের কোনও ব্যাপার নেই। আমরা কষ্টে মরছি। এ রকম চললে আমরা শেষ হয়ে যাব।”

শেষের দিন গোনার এই চরম হতাশাই কি তা হলে নতুন করে কয়েকটি গ্রামে পা রাখতে দিচ্ছে মাওবাদী স্কোয়াডকে!

ঢাঙিকুসুম গ্রামের হাড় জিরজিরে কাজল সিংহ জানান সপ্তাহখানেক আগে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা, “বনপার্টির ওরা সংখ্যায় ছিল সাত। সব ব্যাটাছেলে। পাহাড় থেকে নেমে গ্রামের মধ্যে দিয়ে হেঁটে জঙ্গলে ঢুকে গেল।” কাঁধে বন্দুক ছিল? “দেখতে পাইনি। তবে ওদের প্রত্যেকের পিঠেই ব্যাগ ছিল। ওর মধ্যে কী ছিল, তা কী করে বলি!” বেলপাহাড়ি সদর থেকে ঢাঙিকুসুম প্রায় তিরিশ কিলোমিটার। পথের বেশির ভাগটাই বন্ধুর। এবড়ো-খেবড়ো পাথুরে রাস্তা, পাহাড়-জঙ্গলের দুস্তর বাধা। বেলপাহাড়ির উত্তর-পশ্চিম বরাবর শিমুলপাল হয়ে ওই গ্রামের পথে পড়বে ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংহভূম জেলার চাকুলিয়া এলাকার তিন-চারটি গ্রাম। ফের পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে জঙ্গলের রাস্তায় চার কিলোমিটার। প্রত্যন্ত ও রাজ্যের শেষ প্রান্তের গ্রাম ঢাঙিকুসুম মোবাইল ফোনের পরিষেবা থেকে বিচ্ছিন্ন। মাওবাদীদের ঢোকার খবর পুলিশ পাবে, তার উপায় নেই। তবে মাওবাদীদের ব্যাপারে কি গ্রামবাসীরা পুলিশকে আদৌ খবর দিতে আগ্রহী? কাজলের কথায়, “বনপার্টির লোকজন কাউকে বিরক্ত করে না। নিজেদের মতো আসে, বড়জোর জল-টল খায়।”

পূর্ণাপানি গ্রাম পঞ্চায়েতের ঢাঙিকুসুম গ্রামের মতো শিমুলপাল অঞ্চলের জামাইমারি গ্রামও ঝাড়খণ্ড ঘেঁষা। ওই গ্রামের লইতুনি হাঁসদা জানাচ্ছেন, দু’জন মহিলা-সহ সাত-আট জনের মাওবাদী স্কোয়াডকে তিনি জামড়ার জঙ্গল থেকে আমলাশোলের জঙ্গলে ঢোকার মুখে দেখেছেন দিন দশেক আগে। গ্রামবাসীদের বক্তব্য, বেলপাহাড়ির এই প্রত্যন্ত তল্লাটে ঝাড়খণ্ড-পশ্চিমবঙ্গের সীমানা ঘেঁষা গ্রামগুলিতে আনাগোনা রয়েছে মাওবাদীদের দু’টি স্কোয়াডের। একটি মদন মাহাতোর, অন্যটি শ্যামলের। গোয়েন্দারাও স্বীকার করছেন দু’টি স্কোয়াডের অবাধ আনাগোনার কথা।

আর এক সময়ে ওই সব স্কোয়াডের সঙ্গে যাঁরা ঘুরতেন বা সদস্যও ছিলেন, ক্ষোভ জমছে তাঁদের মধ্যেও। লালগড়ের পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটির প্রতিষ্ঠাতা যুব সদস্যেরা ছ’বছর আগে মাওবাদীদের নির্দেশে আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন, হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। এবং এখনও মাওবাদী নেতাদের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ হয়ে পড়ে, যখন সিজুয়া গ্রামের কিঙ্কর সিংহ বলেন, “জঙ্গলমহলের মুখে সত্যিই হাসি ফুটবে, যদি সরকার ছত্রধর মা

(শেষ)

surbek biswas
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy