Advertisement
E-Paper

দুধের বরাতে অনিয়ম, সই করেও ক্ষোভ মন্ত্রীর

সরকারের লিখিত আদেশনামা রয়েছে। কিন্তু তা মানলেন না সরকারেরই মন্ত্রী। তাঁর নির্দেশে ই-টেন্ডারের তোয়াক্কা না-করেই গুঁড়ো দুধ কেনার প্রায় ২৮ কোটি টাকার বরাত কার্যত পাইয়ে দেওয়া হল দুই ঠিকাদারকে। পাশাপাশি আর এক ঠিকাদার সংস্থাকে নিয়ম বহির্ভূত পথে সরকারি তালিকাভুক্ত (এনরোলমেন্ট) করার জন্যও মন্ত্রীর ঘর থেকে লিখিত সুপারিশ গিয়েছে বলে অভিযোগ।

শ্যামলেন্দু মিত্র

শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৪ ০৩:২৬
স্বপন দেবনাথ

স্বপন দেবনাথ

সরকারের লিখিত আদেশনামা রয়েছে। কিন্তু তা মানলেন না সরকারেরই মন্ত্রী। তাঁর নির্দেশে ই-টেন্ডারের তোয়াক্কা না-করেই গুঁড়ো দুধ কেনার প্রায় ২৮ কোটি টাকার বরাত কার্যত পাইয়ে দেওয়া হল দুই ঠিকাদারকে। পাশাপাশি আর এক ঠিকাদার সংস্থাকে নিয়ম বহির্ভূত পথে সরকারি তালিকাভুক্ত (এনরোলমেন্ট) করার জন্যও মন্ত্রীর ঘর থেকে লিখিত সুপারিশ গিয়েছে বলে অভিযোগ।

দুই অনিয়মের জন্য আঙুল উঠেছে মূলত যাঁর দিকে, তিনি হলেন রাজ্যের প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ। অভিযোগের তিরে বিদ্ধ তাঁর একান্ত সচিবও। সব শুনে মন্ত্রীর অবশ্য বিস্মিত মন্তব্য, “কী করে এ সব হচ্ছে, বুঝতেই পারছি না।” আর অবৈধ এনরোলমেন্ট প্রসঙ্গে মন্ত্রীর সামনে তাঁর একান্ত সচিব সৌমিত্র সেনগুপ্তের ব্যাখ্যা, “বড় ঠিকাদার। মাদার ডেয়ারিতে কাজ পাচ্ছে না। তাই নাম তুলতে বলেছি। এর বেশি তো কিছু করিনি!”

সরকারি কাজে গতি ও স্বচ্ছতা আনার তাগিদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সমস্ত দফতরে ই-টেন্ডার ব্যবস্থা চালু করেছে। সরকারি নির্দেশিকা মোতাবেক, পাঁচ লক্ষ টাকার বেশি মূল্যের কোনও কাজের বরাত দিতে হলে ই-টেন্ডার বাধ্যতামূলক। নবান্নের খবর, কোনও কোনও দফতর আরও কম টাকার কাজের বরাতও ই-টেন্ডারে দিচ্ছে। একই সঙ্গে নিয়ম হয়েছে, কোনও নতুন ঠিকাদার সংস্থার নাম সরকারি বরাতযোগ্যের তালিকায় তুলতে হলেও অনলাইনে আবেদন করতে হবে। তার পরে সংশ্লিষ্ট দফতর বিবেচনা করে দেখবে, এনরোলমেন্টের আর্জিটি আদৌ গ্রহণযোগ্য কি না।

কিন্তু সম্প্রতি প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরে দু’টি নিয়মই পূর্ণমাত্রায় লঙ্ঘিত হয়েছে বলে অভিযোগ। দফতরের খবর, রাজ্য সরকারের বিভিন্ন ডেয়ারিতে দুধ উৎপাদনের জন্য প্রচুর পরিমাণে গুঁড়ো দুধ (স্কিমড মিল্ক পাউডার, সংক্ষেপে এসএমপি) লাগে, যা বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে কেনা হয়। এবং নতুন সরকারের আমলে এত দিন ই-টেন্ডারে গুঁড়ো দুধ কেনা হলেও এই প্রথম তার ব্যতিক্রম হয়েছে। কী ভাবে?

ঘটনার সূত্রপাত গত ২২ মে’র একটি চিঠি। একান্ত সচিবের মাধ্যমে মন্ত্রীকে পাঠানো দু’পাতার চিঠিটিতে রাজ্য সরকারি সংস্থা মাদার ডেয়ারি-র চিফ জেনারেল ম্যানেজার (সিজিএম) উদয়ভানু গঙ্গোপাধ্যায় অবিলম্বে অতিরিক্ত ১১০০ টন গুঁড়ো দুধ কেনার প্রস্তাব দেন। সময় বাঁচানোর স্বার্থে ই-টেন্ডার ছাড়াই তা কেনার কথা বলা হয়। চিঠির বক্তব্য ছিল: এপ্রিলে ই-টেন্ডার মারফত দু’টি সংস্থাকে যে ১২০০ টন গুঁড়ো দুধ জোগানোর বরাত দেওয়া হয়েছে, তাতে বড়জোর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে। কিন্তু উৎসবের মরসুমে দুধ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হলে আরও ১১০০ টন হাতে রাখা জরুরি। “উৎসবের সময়ে গুঁড়ো দুধের জোগান স্বাভাবিক থাকে না। তখন অর্ডার দেওয়া হলে কোনও সংস্থার পক্ষেই সময় মতো এসএমপি সরবরাহ করা সম্ভব নয়।” যুক্তি দিয়েছিলেন সিজেএম। এমতাবস্থায় তাঁর প্রস্তাব ছিল, সর্বশেষ টেন্ডারের ভিত্তিতেই প্রাপক দুই সংস্থাকে বাড়তি ১১০০ টন গুঁড়ো দুধের বরাত দিয়ে দেওয়া হোক। পরে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি, তিন মাসের জন্য নতুন করে ই-টেন্ডার ডাকা যেতে পারে।

মাদার ডেয়ারির কর্তা লিখেছিলেন, তাঁর প্রস্তাব অনুমোদিত হলে ১১০০ টন এসএমপি খরিদ বাবদ ২৭ কোটি ৯৭ লক্ষ ৩০ হাজার টাকার বরাত দিতে হবে। চার দিন বাদে (২৬ মে) মন্ত্রীর একান্ত সচিব তাঁর চিঠির উপরে নোট দিয়ে জানান, বিষয়টি নিয়ে মাদার ডেয়ারির চেয়ারম্যান (পদাধিকারবলে মন্ত্রী) ও অন্যান্য পদাধিকারীদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তাঁরা প্রস্তাবে সায় দিয়েছেন।

৩ জুন ওই চিঠিতেই ফের নোট দিয়ে প্রস্তাবিত দুই সংস্থাকে বরাতদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। যে নির্দেশনামায় সই করেছেন স্বয়ং দফতরের মন্ত্রী স্বপনবাবু।

দফতর-সূত্রের খবর: মাদার ডেয়ারির সিজিএম’কে চিঠি দিয়ে এক ঠিকাদার সংস্থা আবেদন করেছিল, বরাত পাওয়ার যোগ্য হিসেবে বিবেচিত সংস্থাগুলির তালিকায় তার নামও ঢোকানো হোক। ওই চিঠির উপরে মন্ত্রীর একান্ত সচিব নোট দেন, আবেদনকারী সংস্থাটি কাজের ক্ষেত্রে খুবই যোগ্য ও দায়িত্বশীল। তাদের আবেদন গুরুত্ব দিয়ে দেখতে মাদার ডেয়ারি কর্তৃপক্ষকে ‘সুপারিশ’ করেন, যাকে নির্দেশেরই নামান্তর হিসেবে দেখছেন দফতরের আধিকারিকদের অনেকে। তাঁদের কথায়, “এমনিতেই অনলাইন আবেদন না-করলে এনরোলমেনেন্টের বিষয়টি বিবেচনায় আসে না। তার উপরে মন্ত্রীর প্রাইভেট সেক্রেটারির এ হেন নোট!”

পুরো ব্যাপারটাকে সরকারি নিয়ম-নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী বলে তাঁরা অভিহিত করেছেন। স্বয়ং মন্ত্রীও এখন বলছেন, “আমরা সরকারে এসে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ই-টেন্ডার ছাড়া কোনও কাজ হবে না। বুঝতে পারছি না, তার পরেও কী ভাবে এ সব হচ্ছে!” ঘটনাপ্রবাহে ক্ষুব্ধ মন্ত্রী প্রতিবেদকের সামনেই একান্ত সচিবকে ডেকে ধমকের সুরে বলেন, “কী করে এ সব হচ্ছে? কেন ঠিকাদারের জন্য সুপারিশ করেছেন? সুপারিশ ফিরিয়ে নিন।” সৌমিত্রবাবু জবাব দেন, “আমি তো বরাত দিতে বলিনি। শুধু ওদের নাম এনরোল করতে বলেছি। এতে অন্যায় কোথায়?”

সৌমিত্রবাবুর এ হেন ব্যাখ্যা অবশ্য মন্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তিনি পুরো বিষয়টির ফাইল পড়তে থাকেন। দেখেন, ই-টেন্ডার ছাড়াই দু’টি সংস্থা থেকে ১১০০ টন গুঁড়ো দুধ কেনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এবং তাতে একান্ত সচিবের সুপারিশ অনুযায়ী মাদার ডেয়ারি’র চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর সই রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে স্বপনবাবু ফোনে ধরেন উদয়ভানুবাবুকে। বলেন, “ই-টেন্ডার ছাড়া কোনও কাজ হবে না। আমার বা প্রাইভেট সেক্রেটারির সই করা যত ফাইল বা কাগজপত্র মাদার ডেয়ারি’তে আছে, এখনই পাঠিয়ে দিন। আমি সব ছিঁড়ে ফেলে দেব।”

মন্ত্রী এখানেই থামেননি। “মাদার ডেয়ারি’র মধ্যে একটা চক্র কাজ করছে। আমি যখন সেই চক্র ভাঙার চেষ্টা করছি, তখনই এ সব অভিযোগ উঠছে।” পাল্টা তোপ দেগেছেন তিনি। বলেছেন, “আমার সচিবালয় থেকে কেউ কোনও সুপারিশ করতে পারে না। আমিও মন্ত্রী হিসেবে সরকরি আইন মেনে চলতে বাধ্য। দেখছি, ই-টেন্ডার ছাড়া কী ভাবে এত টাকার গুঁড়ো দুধ কেনার নির্দেশ গেল।” বস্তুত স্বপনবাবু এতটাই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন যে, মাদার ডেয়ারির সিজিএম’কে টেলিফোনে বলেন, “আপনি ছেড়ে দিন। সরে যান। তার পরে আমি বুঝে নেব।”

মন্ত্রীর এত ক্ষোভ-বিরক্তির পরেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। অনিয়মের নির্দেশে তো তাঁর স্বাক্ষর জাজ্বল্যমান! তা হলে কি সচিবের উপরে ‘অন্ধ’ ভরসা রেখে মন্ত্রী ফাইল সই করেছেন? নাকি সব দেখেশুনেই মঞ্জুরি দিয়েছেন?

স্বপনবাবু এমন বিতর্কের মধ্যে ঢুকতে চাননি। আর বিধিভঙ্গ হচ্ছে জেনেও তিনি ই-টেন্ডার ছাড়া গুঁড়ো দুধ কেনার প্রস্তাব মন্ত্রীকে দিয়েছিলেন কেন, উদয়ভানুবাবুও সে প্রসঙ্গে মুখ খুলতে নারাজ।

swapan debnath west bengal dairy minister shamalendu mitra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy