ব্রিগেডে সূর্য-বিমানের সঙ্গে প্রকাশ কারাটও। —নিজস্ব চিত্র।
নেতাই নিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মন্তব্যের প্রতিবাদে রবিবার বামফ্রন্টের ব্রিগেড সমাবেশে যোগ দিলেন না লালগড়ের সিপিএম নেতা-কর্মী-সমর্থকদের একটা বড় অংশ।
পশ্চিম মেদিনীপুরের নেতাই গ্রামটি লালগড় এলাকারই অন্তর্ভুক্ত। লালগড়ের ওই সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের বক্তব্য, ব্রিগেডে না-গিয়ে তাঁরা বুদ্ধদেবকে বার্তা দিতে চেয়েছেন। বুদ্ধবাবুই ছিলেন এ দিনের সমাবেশের প্রধান বক্তা। পার্টির লালগড় লোকাল কমিটির সদস্য তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “আমাদের কয়েক জন নেতা-কর্মীর কোনও অপরাধ না-থাকা সত্ত্বেও তাঁরা নেতাই-মামলার অভিযুক্ত হিসেবে ফেঁসে রয়েছেন। সেই সময়ে বুদ্ধবাবুর ওই অবিবেচক মন্তব্য আমাদের ক্ষতি করবে।” এবং এরই প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁরা এ দিন ফ্রন্টের ব্রিগেড সমাবেশ থেকে দূরে থেকেছেন বলে দাবি করেছেন তরুণবাবু। নেতাই-মামলায় অভিযুক্ত সিপিএমের আট নেতা-কর্মী এখনও ফেরার। “প্রকাশ্য সভায় বুদ্ধবাবু উল্টোপাল্টা বলবেন, আর পরে বন্ধ ঘরে ভুল স্বীকার করবেন, তা চলবে না। আবার প্রকাশ্য সভায় তাঁকে ঘোষণা করতে হবে, নেতাই নিয়ে উনি ভুল বলেছিলেন, এবং তা প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন,” মন্তব্য তরুণবাবুর।
পশ্চিম মেদিনীপুরেই দলের ছোট একটি অংশের অবশ্য বক্তব্য, বুদ্ধবাবু যা বলেছেন, সবটাই নিজের বিশ্বাস থেকে। তিনি যদি ভুল স্বীকার করে থাকেন, তাই নিয়ে এত হইচইয়ের কী আছে! বরং এই ভুল স্বীকারের ফলে দলের ভাল হওয়ারই সম্ভাবনা।
লালগড়ে সিপিএমের লোকাল কমিটির সদস্য সংখ্যা ১৫। দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এঁদের মধ্যে জনা দশেক এ দিন ব্রিগেডের জনসভায় যোগ দেননি। লালগড় লোকাল কমিটির আওতাভুক্ত এলাকায় পার্টির প্রায় ১৩০ জন সদস্য রয়েছেন। তাঁদের অন্তত একশো জন ব্রিগেডমুখী হননি। এমনকী, তাঁরা ব্রিগেডের সভার সমর্থনে এলাকায় পোস্টারও সাঁটেননি। পার্টির লালগড় লোকাল কমিটির সম্পাদক অর্জুন মান্ডি অবশ্য রামগড় থেকে জনা ৮০ কর্মী-সমর্থককে নিয়ে ব্রিগেডে হাজির ছিলেন।
এ দিন ব্রিগেডে লালগড়ের পার্টি সদস্য-সমর্থকদের একাংশের অনুপস্থিতির কথা স্বীকার করে নিলেও সিপিএমের জেলা নেতৃত্ব কিন্তু সরাসরি মানতে চাননি যে, নেতাই-কাণ্ড সম্পর্কে বুদ্ধবাবুর মন্তব্যের প্রতিবাদেই ওঁরা ব্রিগেড থেকে মুখ ফুরিয়ে থেকেছেন। সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক তথা দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দীপক সরকারের দাবি, “কেউ কেউ হয়তো কোনও ব্যক্তিগত সমস্যার জন্য ব্রিগেডে থাকতে পারেননি। তবে নেতাই-কাণ্ড সম্পর্কে বুদ্ধবাবুর মন্তব্যের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই।”
বস্তুত বুদ্ধবাবুর ওই মন্তব্যের বিষয়টির এখন কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই বলে দীপকবাবু মনে করছেন। যদিও জঙ্গলমহলে সিপিএম নেতাদের একাংশের গলায় কিঞ্চিৎ অন্য সুরও শোনা যাচ্ছে। “নেতাই নিয়ে বুদ্ধবাবুর মন্তব্যের জন্য লালগড়ে আমাদের কর্মী-সমর্থকদের অনেকেই অসন্তুষ্ট। জেলা নেতৃত্বের উচিত ছিল, সমাবেশের আগে লালগড়ে গিয়ে ওঁদের সঙ্গে কথা বলে বোঝানো।” বলছেন জঙ্গলমহলে দলের এক প্রবীণ নেতা। লালগড়ে সিপিএমের স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশের বক্তব্য, ২০১১-র ৭ জানুয়ারি নেতাই গ্রামে পার্টিকর্মী রথীন দণ্ডপাটের বাড়ি থেকে ছুটে আসা গুলিতে ন’জন গ্রামবাসীর মৃত্যুর ঘটনা অবশ্যই দুঃখজনক। কিন্তু ওই দিন মাওবাদীদের চক্রান্তের প্রেক্ষিতটাও বোঝা প্রয়োজন। লোকাল কমিটির এক সদস্যের কথায়, “মাওবাদীরা যা পরিকল্পনা করেছিল, তাতে রথীন দণ্ডপাটের বাড়িতে থাকা আমাদের ২৫-৩০ জন কর্মীর সবাই খুন হয়ে যেত! ভয় পেয়ে, প্রাণে বাঁচতে ওরা গুলি চালিয়েছিল।”
আর বুদ্ধবাবু যে হেতু সেই সময়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তাই নেতাইয়ের ওই বাড়িতে সশস্ত্র শিবির বসানোর দায় তাঁর উপরেও বর্তায় বলে মনে করছেন তাঁর দলেরই স্থানীয় কর্মী-সমর্থকদের অনেকে। বুদ্ধবাবুর মন্তব্য ঘিরে অন্যান্য মহলেও চলছে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পর্ব। এ দিন ‘শহিদ স্মৃতিরক্ষা কমিটি’র উদ্যোগে নেতাই গ্রামে প্রতীকী অরন্ধন পালিত হয়। বিকেলে গ্রামের শহিদ বেদির সামনে থেকে কমিটি ‘ধিক্কার মিছিল’ বার করে, যাতে সামিল হন নিহতদের পরিবারের সদস্য-সহ স্থানীয় বহু মানুষ। মিছিল লালগড় ব্লক সদর পরিক্রমা করে লালগড়ের এসআই চকে পৌঁছলে সেখানে বুদ্ধবাবুর কুশপুতুল পোড়ানো হয়। তৃণমূল প্রভাবিত ওই শহিদ স্মৃতিরক্ষা কমিটির সভাপতি দ্বারিকানাথ পণ্ডা বলেন, “বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নেতাইয়ের ঘটনার জন্য ভুল স্বীকার করেননি। রাজনীতির স্বার্থে এখন করছেন। এই দ্বিচারিতার বিরুদ্ধেই আমাদের প্রতিবাদ।”
আগামী ৩ মার্চ নেতাই-মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ার কথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy