Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

নজরে কলকাতাও, লোকসভার ভিতে বাড়তে চাইছে বিজেপি

লোকসভা ভোটে সাফল্য এসেছে মোদী-হাওয়ায়। সেই সাফল্যকে ভিত্তি করে এ বার রাজ্যে আরও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় নেমে পড়ল বিজেপি। তাদের সামনে প্রথম লক্ষ্য আগামী বছর কলকাতা পুরসভার নির্বাচন। তার পরে ২০১৬-র বিধানসভা ভোট। বিজেপি সূত্রের খবর, মোদী-ঝড়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কেন্দ্রে সরকার গড়ার ক্ষমতা পাওয়ার পরে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখন দু’টি রাজ্যের ব্যাপারে উৎসাহিত।

রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের সঙ্গে সদ্যজয়ী সাংসদ বাবুল। কলকাতায় দলীয় কার্যালয়ে। ছবি: রণজিৎ নন্দী

রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের সঙ্গে সদ্যজয়ী সাংসদ বাবুল। কলকাতায় দলীয় কার্যালয়ে। ছবি: রণজিৎ নন্দী

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৪ ০২:৫০
Share: Save:

লোকসভা ভোটে সাফল্য এসেছে মোদী-হাওয়ায়। সেই সাফল্যকে ভিত্তি করে এ বার রাজ্যে আরও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় নেমে পড়ল বিজেপি। তাদের সামনে প্রথম লক্ষ্য আগামী বছর কলকাতা পুরসভার নির্বাচন। তার পরে ২০১৬-র বিধানসভা ভোট।

বিজেপি সূত্রের খবর, মোদী-ঝড়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কেন্দ্রে সরকার গড়ার ক্ষমতা পাওয়ার পরে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখন দু’টি রাজ্যের ব্যাপারে উৎসাহিত। উত্তরপ্রদেশে যে ভাবে ৮০টির মধ্যে ৭১টি আসন বিজেপি পেয়েছে, তাতে তারা পরের বার বিধানসভা ভোটে লখনউয়ের তখ্তে বসার স্বপ্ন দেখছে। পাশাপাশি, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে ভোট নিয়ে বিস্তর অভিযোগ ওঠার পরেও বিজেপি যে ভাবে ভোট বাড়াতে পেরেছে, তা-ও বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে আশাবাদী করে তুলেছে। দলের রাজ্য নেতৃত্বকে তাঁরা সবুজ সঙ্কেত দিয়েছেন সর্বশক্তি দিয়ে বাংলায় ময়দানে নেমে পড়ার জন্য।

বিজেপির যুক্তি এখন খুব সরল। শাসক দল তৃণমূল এ বার পেয়েছে ৩৯% ভোট। তৃণমূলের বাইরে আছে ৬১% ভোট। দেশ জুড়ে বিপর্যয়ের পরে কংগ্রেস এবং রাজ্যে ভরাডুবির জেরে স্বভাবতই হতমান হয়ে পড়বে বামেরা। এই পরিস্থিতিতে বিজেপি-র লক্ষ্য, বিরোধী পরিসরের ভোটকে যথাসম্ভব নিজের দিকে টেনে আনা। সেই লক্ষ্য মাথায় রেখে শনিবার থেকেই তারা পুরসভা ভোটের জন্য ঘুঁটি সাজাতে শুরু করে দিয়েছে।

পরিসংখ্যান বলছে, গোটা রাজ্যে ৪২টি লোকসভা আসনের নিরিখে বিজেপি পেয়েছে প্রায় ১৭% ভোট। এর মধ্যে ১৩টি আসনে তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার ২০% ছাড়িয়েছে। গত বার লোকসভা ভোটে রাজ্যে তাদের ভোট ছিল ৬.৫%। তার মধ্যে দার্জিলিং কেন্দ্রেই বিজেপি পেয়েছিল ৫১.৫%। পাহাড় বাদ দিয়ে দেখলে বাকি কেন্দ্রগুলিতে গড় ভোট সে ক্ষেত্রে অনেক কমে আসে। এ বার তারা দার্জিলিঙে পেয়েছে ৪৩.৮%। সুতরাং অঙ্কের হিসেবেই বোঝা যাচ্ছে, পাহাড়কে সরিয়ে রেখে ভাবলেও রাজ্যের অন্যত্র বিজেপির গড় ভোট ভালই বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজ্যে ২৯% মুসলিম ভোটকে সরিয়ে রাখলে বাকি ভোটের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই বিজেপি নিজের ঝুলিতে ভরতে পেরেছে বলা যায়। তিনটি আসনে তারা দ্বিতীয় হয়েছে। তৃতীয় স্থানে শেষ করেছে ২৯টি আসনে, তার মধ্যে বেশ ক’টিতে দ্বিতীয় স্থানাধিকারীর সঙ্গে তাদের ভোটের ফারাক সামান্য। লোকসভা ভোটের এই ফলকে বিধানসভা কেন্দ্রওয়াড়ি হিসেবে ধরলে রাজ্যে এখন পাহাড়ের তিনটি কেন্দ্র ছাড়া ২১টি আসনে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। তার মধ্যে পাহাড়ের তিনটি গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার জন্য ছেড়ে দিলে ১৮টি বিধানসভা আসনে এগিয়ে বিজেপি।

সাফল্যের এই প্রাথমিক হিসেব-নিকেশ নিয়েই এ দিন বসেছিল বিজেপির রাজ্য কার্যনির্বাহী সমিতির বৈঠক। সেখানে জেলা থেকে আসা নেতারা হিসাব দিয়ে দেখিয়েছেন, শাসক দলের বিরুদ্ধে বুথ দখল এবং ভোট লুঠের অভিযোগ না উঠলে বিজেপির ভোটের হার ২৫%-এ গিয়ে দাঁড়াতে পারত। এবং সেটা হলে অনেক আসনেরই ফল অন্য রকম হতো! নানা তথ্য হাতে পাওয়ার পরে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেছেন, “আগামী বছর কলকাতা পুরসভার ভোট। তারও আগে আমাদের এ বার জেতা আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে আসানসোল ও কুলটি পুরসভার ভোট আছে। আমরা তার জন্য এখনই প্রস্তুতি শুরু করছি।”

কেন কলকাতা নিয়ে আশাবাদী হচ্ছে বিজেপি? বিধানসভা ভিত্তিক হিসেবে শহরের মধ্যে ভবানীপুর ও জোড়াসাঁকো কেন্দ্রে এগিয়ে আছে তারা। এগিয়ে আছে শহর লাগোয়া বিধাননগরেও। ভবানীপুরে ব্যবধান ১৮৫ ভোটের হলেও জোড়াসাঁকোয় তা ১৫ হাজার। ওয়ার্ড-ভিত্তিক হিসাব যতটুকু পাওয়া গিয়েছে, সেই অনুযায়ী কলকাতা পুরসভার ১৪১টির মধ্যে ৩৭টি ওয়ার্ডে এগিয়ে বিজেপি! কলকাতায় এখন তাদের কাউন্সিলর আছেন তিন জন। বাকি যে ৩৪টি ওয়ার্ডে তারা এগিয়েছে, তার সিংহ ভাগই এখন তৃণমূলের দখলে। শাসক দলের এক প্রথম সারির নেতা মেনে নিচ্ছেন, “তৃণমূলের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে এখন উঠে আসছে বিজেপি। বিশেষ করে, আগামী বছরের কলকাতা পুরসভার ভোটের কথা ভেবে বিজেপি-কে মাথায় রাখতেই হচ্ছে।”

এই পরিস্থিতিতে কলকাতার ১৪১টি ওয়ার্ডকে চারটি এলাকায় ভাগ করে চার জন নেতাকে এখন থেকেই দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। ওয়ার্ড ধরে ধরে সংগঠন গড়ে তুলতে পারলে তা কাজে লাগবে দু’বছর পরের বিধানসভা ভোটেও। বিজেপির আশা, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নিজেদের নিয়মিত উপস্থিতি টের পাওয়াতে পারলে শহরের মানুষের আরও সমর্থন তাঁরা পাবেন।

শুধু কলকাতাই নয়, বিজেপি-র উত্থানের বীজ রোপন হয়েছে অন্যত্রও। রাজ্য বিজেপি-র অন্যতম সাধারণ সম্পাদক এবং বালুরঘাটের প্রার্থী বিশ্বপ্রিয় রায়চৌধুরী জানাচ্ছেন, মালদহের ইংরেজবাজার পুরসভার ২৫টির মধ্যে ২৪টি ওয়ার্ডেই এখন এগিয়ে মোদীর দল! মতুয়া-অধ্যুষিত বনগাঁ লোকসভা আসনে গত বারের ৪% থেকে বেড়ে বিজেপি-র ভোট হয়েছে ১৯%। রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রে তাদের ভোট বেড়েছে প্রায় ১২%। আবার এগিয়ে-থাকা বিধানসভা কেন্দ্রগুলির মধ্যে আছে বসিরহাট-দক্ষিণ। সিপিএমের বর্ষীয়ান বিধায়ক নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে যেখানে উপনির্বাচন আসন্ন। লোকসভা ভোটের ফলে ওই

কেন্দ্রে তৃণমূলের চেয়ে বিজেপি এগিয়ে প্রায় ২৫ হাজার ভোটে। আর তৃতীয় স্থানে নেমে গিয়েছে বামেরা। তাই বসিরহাট দক্ষিণে জিতেই আপাতত বিধানসভায় প্রবেশের স্বপ্ন দেখছে বিজেপি।

লোকসভার ফলে হতোদ্যম হয়ে পড়লেও এখন থেকেই উপনির্বাচনের জন্য নেমে পড়তে চাইছেন উত্তর ২৪ পরগনার সিপিএম জেলা সম্পাদক গৌতম দেবও। লোকসভা ভোটের আগে তিনি যা বলেছিলেন, তার কিছুই অবশ্য মেলেনি। এত চেষ্টা যখন সফল হচ্ছে না, উপনির্বাচনে কি ইতিবাচক কিছু হবে? গৌতমবাবু এ দিন বলেছেন, “চেষ্টা তো করতেই হবে! সেটাই এখন বড় কাজ।” সিপিআইয়ের জেলা সম্পাদক স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, বসিরহাটের ওই কেন্দ্রে বামেদের ভোট চলে গিয়েছে বিজেপি-তে। এত তাড়াতাড়ি সেই ভোট ফেরার আশা না করাই ভাল। তবে রাজারহাট-সহ জেলার চার পুরসভার ভোটেই বিজেপি-র দিকে চলে যাওয়া ভোট ঘরের ফেরানোর চেষ্টা চালাবে বামেরা।

অন্য দিকে বিজেপি-র চেষ্টা, এই সুযোগে অন্যান্য দল থেকে আসা কর্মী-সমর্থকদের ঝাড়াই-বাছাই করে দলে নেওয়া। রাহুলবাবু জানিয়েছেন, পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার ফিরান্দা গ্রামে সিপিএমের কার্যালয়ের বোর্ড লাগিয়ে তাদের কর্মীরাই রাতারাতি বিজেপি হয়ে গিয়েছেন! এই রকম ঘটনা অদূর ভবিষ্যতে আরও ঘটবে বলে রাহুলবাবুদের ধারণা। কংগ্রেস এবং তৃণমূলেরও বিক্ষুব্ধ কর্মী-সমর্থকদের একাংশ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেছে বলে বিজেপি-র দাবি। রাহুলবাবুর বক্তব্য, “দেশে এই রকম জয়ের পরে কর্মী-সমর্থকেরা চাঙ্গা আছেন। কর্মকর্তাদের মনোবল আরও বাড়াতে আমরা ব্লক সম্মেলন শুরু করব শীঘ্রই।”

বিজেপি-র রাজ্য নেতৃত্বের আশা, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে বাংলায় যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা কাজে লাগাতে সুবিধা হবে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ডাকে আসানসোলের জয়ী প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয় যেমন এ দিনই দিল্লি গিয়েছেন। রাজ্য বিজেপি-তে তাঁকে যুব সংগঠন বা অন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে আগ্রহী কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। আবার রাজ্য বিজেপি-র একাংশের আশা, নবাগত বাবুল এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিক সুরিন্দর সিংহ অহলুওয়ালিয়া, দু’জনকেই কেন্দ্রে মন্ত্রী করে রাজ্যে দলকে নবজাগরণের বার্তা দেওয়া হতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bjp lok sava
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE