Advertisement
১১ মে ২০২৪

প্রশ্ন নয়, ফের মুখে লাগাম তৃণমূলে

যত বার আলো জ্বালাতে চাই, নিভে যায় বারেবারে! অজস্র বিড়ম্বনায় জেরবার তৃণমূল নেতৃত্বের দশা এখন অনেকটা এমনই! অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচতে বারেবারে দলে শৃঙ্খলার ফরমান জারি হচ্ছে। আর বারেবারেই কেউ না কেউ বেফাঁস মুখ খুলে বা ভিন্ন পথে হেঁটে বিড়ম্বনা বাড়িয়ে দিচ্ছেন! নিরন্তর এই লুকোচুরির মধ্যেই ফের একপ্রস্ত মুখে লাগাম পরানোর চেষ্টা হল শাসক দলে। এ বারের উপলক্ষ সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সাধন পাণ্ডের মতো বর্ষীয়ান মন্ত্রীদের যাদবপুর-কাণ্ডে বেসুর গাওয়া।

মুখ খুলে দলের বিড়ম্বনা বাড়িয়েছেন (বাঁ দিক থেকে) সাধন পাণ্ডে, সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং সৌগত রায়।

মুখ খুলে দলের বিড়ম্বনা বাড়িয়েছেন (বাঁ দিক থেকে) সাধন পাণ্ডে, সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং সৌগত রায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৪:০৩
Share: Save:

যত বার আলো জ্বালাতে চাই, নিভে যায় বারেবারে!

অজস্র বিড়ম্বনায় জেরবার তৃণমূল নেতৃত্বের দশা এখন অনেকটা এমনই! অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচতে বারেবারে দলে শৃঙ্খলার ফরমান জারি হচ্ছে। আর বারেবারেই কেউ না কেউ বেফাঁস মুখ খুলে বা ভিন্ন পথে হেঁটে বিড়ম্বনা বাড়িয়ে দিচ্ছেন! নিরন্তর এই লুকোচুরির মধ্যেই ফের একপ্রস্ত মুখে লাগাম পরানোর চেষ্টা হল শাসক দলে। এ বারের উপলক্ষ সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সাধন পাণ্ডের মতো বর্ষীয়ান মন্ত্রীদের যাদবপুর-কাণ্ডে বেসুর গাওয়া।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে ছাত্রী গীতশ্রী সরকারের প্রতিবাদের পাশে দাঁড়িয়ে সুব্রতবাবু দরাজ সার্টিফিকেট দেওয়ার পরেই ক্রুদ্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে নিজের অসন্তোষ জানিয়ে দিয়েছিলেন। রাজ্য মন্ত্রিসভায় সুব্রতবাবুর অনুজ সহকর্মী ফিরহাদ হাকিমকে দিয়ে পাল্টা বিবৃতিও জারি করানো হয়েছিল মমতার পরামর্শে। তার পরেও ‘দলের লাইনে’র বাইরে গিয়ে আর এক মন্ত্রী সাধনবাবু মন্তব্য করেছিলেন, যাদবপুরের উপাচার্যের আত্মসম্মান নিয়ে সরে দাঁড়ানো উচিত। সাধনবাবুকে সোমবার তৃণমূল ভবনে ডেকে কড়া হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। তলব করা হয়েছে তাঁর জবাবদিহিও। দলের দুই শীর্ষ নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং সুব্রত বক্সী তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, দল এবং সরকারের অবস্থানের বাইরে প্রকাশ্যে মুখ খোলা কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। দলীয় নেতৃত্বের তিরস্কারে মর্মাহত হলেও সাধনবাবু এই নিয়ে আর কোনও বিতর্কে জড়াননি, প্রকাশ্যে মন্তব্যও করেননি।

কিন্তু তৃণমূল ভবনের উপরে যখন এই অনুশাসন-পর্ব চলছে, নীচে তখন ফের কিঞ্চিৎ ভিন্ন সুর গেয়ে দিয়েছেন শাসক দলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায়! দলনেত্রী শহরের বাইরে থাকায় ২১ জুলাই কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে এ দিন কোনও মন্তব্যই করা হবে না, এমন অবস্থান নিয়েছিল তৃণমূল। অথচ সৌগতবাবু সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে চুপ করে না থেকে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দিয়েছেন! যা জেনে পরে ফের বিড়ম্বনা এবং উষ্মা তৈরি হয়েছে তৃণমূল নেতৃত্বে। দলেরই এক নেতার মন্তব্য, “আমাদের নেতা-মন্ত্রীদের অনেকেই মনে যা ভাবছেন আর যা বলতে হচ্ছে, দু’টো আলাদা। অনেক সময় তাই ছায়াছবির মতো লিপ মিলছে না! ভয়ঙ্কর অবস্থা!”

শৃঙ্খলার লাগাম পরানোর চেষ্টা এবং বারেবারেই তা ফস্কে যাওয়ার এই কাহিনির মাঝে তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য, এ বারের অনুশাসন-পর্বে আর সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়কে। সারদা-কাণ্ডে কোণঠাসা মুকুল ইদানীং জনসমক্ষে বিশেষ দেখা দিচ্ছেন না। তৃণমূল নেত্রীও তাঁর দল পরিচালনার প্রক্রিয়া থেকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিচ্ছেন মুকুলকে। পরিবর্তে এগিয়ে দিচ্ছেন ‘যুবরাজ’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তৃণমূল ভবনে এ দিন রাজ্য তৃণমূলের নবগঠিত কোর কমিটির বৈঠকে (৩৮ জনের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ২২ জন) মুকুল ছিলেন না বলেই তৃণমূল সূত্রের খবর। পূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন অভিষেক। দলের সদস্যপদ সংগ্রহ এবং নবীকরণের প্রক্রিয়া এত দিন ছিল মুকুলের হাতেই। এ বার ওই কাজের জন্য সুব্রত বক্সীর নেতৃত্বে ‘স্ক্রুটিনি কমিটি’ গড়ে তাতে পার্থবাবু, অরূপ বিশ্বাস, ফিরহাদের সঙ্গে রাখা হয়েছে অভিষেককে। সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল সেই কমিটির এক জন সদস্য মাত্র! খড়গপুরে আজ, মঙ্গলবার দুই মেদিনীপুর জেলার কর্মী সম্মেলনেও দলনেত্রী তথা পিসি মমতার পাশে বক্তা হিসাবে রাখা হচ্ছে অভিষেককে। দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “মুকুল-রাজ এখন অস্তের পথে! সে সারদা-কাণ্ডের জল যে দিকেই গড়াক।”

কোর কমিটির বৈঠকের পরে এ দিন মন্ত্রী সুব্রতবাবুকে পাশে বসিয়েই তৃণমূলের মহাসচিব পার্থবাবু বলেছেন, “আমরা আলোচনা করেছি, যাদবপুর বা কোনও বিষয়ে কিছু বলার থাকলে দলের মধ্যেই বলতে হবে। বাইরে বলা যাবে না। বললে দলের লাইন মেনেই বিচার হবে।” পাশে-বসা সুব্রতবাবুকে দেখে অবশ্য মনে হয়নি, তিনি অনুতপ্ত! আগের রাতেও তিনি প্রকাশ্যে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সমাবর্তন নিয়ে যা বলেছেন, তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়! তবে এ দিন আর ওই প্রসঙ্গে প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি।

মুখে আপাতত কুলুপ এঁটেছেন সাধনবাবুও। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতাদের ক্ষোভ, “সাধনদা তো দলের নীতি বা দল-বিরোধী কোনও মন্তব্য করেননি! যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি সাধারণ ভাবে তাঁর অভিমত বলেছেন। এর জন্য তাঁকে ডেকে মুখে লাগাম দেওয়ার মানে কী?” মন্ত্রী সাধনবাবু তৃণমূল ভবন থেকে নিজের দফতরে ফিরে সরকারি কাজেই ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু উত্তর কলকাতায় তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্রে দলের নেতা-কর্মীদের প্রশ্ন, দলনেত্রী নিজে আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যা মেটাতে বলেন। সেখানে সাধনবাবুর মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মুখে লাগাম পরালে স্বাধীন ভাবে আর মতামত দেবে কে? দলে গণতন্ত্রই বা কোথায়?

তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা অবশ্য বুঝছেন, বিবেক, গণতন্ত্র এ সবের মানেই এখন বিপদ! তাই ব্যর্থ হলেও লাগাম হাতে দৌড়তে হচ্ছে বারবার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE