গলির বাঁক ঘুরে বাড়িটার হাত বিশেকের মধ্যে আসতেই পাশের আসবাবের দোকান থেকে এগিয়ে এল ছেলেটি।
“কী দাদা, কাউকে খুঁজছেন?”
“না তো। পিয়ালীদের বাড়ি যাব।”
“সে তো বুঝতেই পারছি, মিডিয়ার মাল!”
ছেলেটি ঠোঁট বেঁকিয়ে আপাদমস্তক জরিপ করে।
“ফালতু প্রশ্ন-টসনো করবেন না...বুঝেছেন?”
ধরা পড়ে যাওয়া মুখ, এ ক্ষেত্রে মাথা নুইয়ে সম্মতি জানানোই সেরা উপায়। ছাড়পত্রও মিলে যায়।
তখনও বোঝা যায়নি, এটা প্রথম হার্ডল।
পাশের চায়ের দোকান থেকে যে চার জোড়া চোখ এতক্ষণ ছানবিন করছিল, দু’পা এগোতেই প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে এগিয়ে আসে তারাও।
কী পিয়ালীর ইন্টারভিউ?
“না ওঁর সাক্ষাৎকার আর কী করে নেব! দেখি বাড়ির কাউকে যদি পাওয়া যায়।”
ওই হল। যান, তবে সমঝে...হ্যাঁ, বেশি কোসচেন করবেন না!
এত সতর্কতা কেন? উত্তর এল “আমরা পাড়ার ছেলে। সব কিছুই দেখতে হয়...বুঝলেন।”
বর্ধমানের গোলাপবাগে পিয়ালী মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির প্রবেশপথে শনিবারের হার্ডলগুলো ছিল এমনই।
গত বছরের ২৬ মার্চ, কলকাতার রাজারহাটের ফ্ল্যাটে মদন মিত্রের ঘনিষ্ঠ, দলের আইনজীবী সেলের এই নেত্রীর ঝুলন্ত দেহ মিলেছিল। জলঘোলা হয়েছিল ঢের। পুলিশ পরিবহণমন্ত্রীকে বিশেষ ঘাঁটায়নি। তবে সে সময় বর্ধমানের গেলাপবাগে পিয়ালীর বাপেরবাড়ি লাগোয়া এলাকায় দলের তরফে এক রকম ‘নজরদারি’ ছিল। পাছে বেঁফাস কিছু বাইরে বেরোয়। সতর্কতার সেই ঘেরাটোপ যে আলগা হয়নি, এ দিন তা ফের মালুম হল।
বিবাহিত হলেও রাজারহাটের ওই ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন পিয়ালী। স্বামী সুভাষ কিংবা বছর পাঁচেকের মেয়ে সংবৃত্তাও থাকত বর্ধমানের বাড়িতে। দরজা ভেঙে পুলিশ পিয়ালীর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধারের পরে কুড়িয়ে পেয়েছিল সুইসাইড নোট। লেখা ছিল অবসাদগ্রস্ত, হতাশ ও একাকীত্বের জীবন থেকে আর কিছু পাওয়ার নেই। কিন্তু সেই হাতের লেখা কি পিয়ালীর? পরিবারের লোকেরা ধোঁয়াশা রেখে জানিয়েছিলেন সে দিন‘পুলিশ তদন্ত করে দেখুক’। সে তদন্ত চলছে।
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্ধমানের আইন কলেজে পড়ার সময় থেকেই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন পিয়ালী। তাঁর নেতৃত্বেই কলেজে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ শাখা খুলেছিল। সেই সূত্রে তৃণমূলের বেশ কিছু প্রথম সারির নেতার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। আইন পাশ করে পরে কলকাতায় চলে আসেন তিনি। একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজ পেয়েছিলেন। পরে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন। পিয়ালীর ল্যাপটপে তাঁর সঙ্গে চার নেতা-মন্ত্রীর ভিডিও-ছবি পাওয়়া গিয়েছিল বলে জানিয়েছিল পুলিশ। মদনের নাম জানা গিয়েছিল সেই সময়েই।
নিরাপত্তা-বলয় টপকে এ দিন পিয়ালীর বাড়ি পৌঁছে দেখা গেল তাঁর ছবিতে এখনও টাটকা মালা।
“আপনার দিদির সঙ্গে তো মদনবাবুর এক সময় খুবই হৃদ্যতা ছিল, পারিবারিক ভাবেও তো আপনারা মদনবাবুর কাছ থেকে উপকৃত...।” প্রশ্ন শেষ করতে দেন না তাঁর ভাই প্রীতম।
তাতে কী হল? দিদি চলে গিয়েছে দেড় বছর হয়ে গেল। দিদি যা করেছিল, নিজের কৃতিত্বেই করেছিল। আর মদনবাবুর গ্রেফতারের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে কী করবো?”
“না, মদনবাবু তো আপনাদের চেনা লোক, গ্রেফতার হয়েছেন তো...।”
কী বলব বলুন তো? আমাদের তো কত লোকের সঙ্গে চেনা। তাদের কত জন তো গ্রেফতার হয়েছেন। আমরা কি সকলের খোঁজ রেখেছি, যে মদনবাবুর ব্যাপারে রাখবো!” ঝাঁঝিয়ে ওঠেন প্রীতম।
তিনি জানাচ্ছেন, পুলিশের সঙ্গে ‘নিয়মিত’ কথা হয় তাঁদের। কিন্তু কেন দিদি আত্মহত্যা করলেন, প্রশ্ন গড়ালেই চুপ করে যায় পুলিশ। প্রীতমের গলায় হতাশা। রান্নাঘর থেকে পিয়ালীর মা অঞ্জনাদেবী বলেন, “কেন বার বার এসে ওই ঘটনাটা নিয়ে কাটাছেঁড়া করেন? শান্তিতে থাকতে দিন তো।”
গোলাপবাগের আমতলা মোড়ের ওই গলিতেই পিয়ালীর শ্বশুরবাড়ি। সে দরজায় অবশ্য কড়া নেড়েও সাড়া মেলেনি।