Advertisement
১১ মে ২০২৪
বিধায়ক বিলকুল বেপাত্তা

ফোনে মিলল সাড়া, পুলিশের দাবি ‘পলাতক’

রাজ্যে চতুর্থ দফার ভোটে সোনামুখীর বুথ দখল মামলায় ১০ জনকে গ্রেফতার করল পুলিশ। তবে মূল অভিযুক্ত তৃণমূল বিধায়ক দীপালি সাহা এখনও অধরা। একাধিক জামিন অযোগ্য ধারায় দীপালির বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছে ঠিকই। কিন্তু বাঁকুড়া জেলা পুলিশের দাবি, দীপালিদেবী পলাতক। বৃহস্পতিবার দিনভর পুলিশ দীপালিদেবীর নাগাল পায়নি বলে দাবি করলেও আনন্দবাজারের তরফে ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছিল দীপালিদেবীর সঙ্গে। সোনামুখীর এই বিধায়কের বাড়ি সোনামুখী থানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৪ ০৩:১৮
Share: Save:

রাজ্যে চতুর্থ দফার ভোটে সোনামুখীর বুথ দখল মামলায় ১০ জনকে গ্রেফতার করল পুলিশ। তবে মূল অভিযুক্ত তৃণমূল বিধায়ক দীপালি সাহা এখনও অধরা। একাধিক জামিন অযোগ্য ধারায় দীপালির বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছে ঠিকই। কিন্তু বাঁকুড়া জেলা পুলিশের দাবি, দীপালিদেবী পলাতক।

বৃহস্পতিবার দিনভর পুলিশ দীপালিদেবীর নাগাল পায়নি বলে দাবি করলেও আনন্দবাজারের তরফে ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছিল দীপালিদেবীর সঙ্গে। সোনামুখীর এই বিধায়কের বাড়ি সোনামুখী থানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে। তিনি বাড়িতে আছেন নাকি গা-ঢাকা দিয়েছেন, তা যদিও স্পষ্ট নয়। দিনের অনেকটা সময় তাঁর দোতলা বাড়ির গেটে তালা ঝুলতে দেখা গিয়েছে। এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, এ দিন একবারও দীপালিদেবীর বাড়িতে আসতে দেখা যায়নি পুলিশকে। ফলে আরও এক বার পুলিশের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা।

দীপালি কোথায় আছেন, এ ব্যাপারে নানা কথা বলছেন তৃণমূলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। একাংশের দাবি, বুধবার সন্ধ্যাতেই দীপালি বড়জোড়া হয়ে কলকাতা চলে গিয়েছেন। আবার দীপালির ঘনিষ্ঠ এক তৃণমূল নেতার বক্তব্য, “উনি বাড়িতেই রয়েছেন। এ দিন সকালে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখাও করেছি।” এলাকার কিছু বাসিন্দা আবার জানালেন, বুধবার রাতে দীপালিদেবী তাঁর স্বামী সমীর সাহার সঙ্গে বাড়িতে ছিলেন। ভোরে তাঁরা খড়্গপুরে গিয়েছেন। বাড়িতে এক জন কেয়ারটেকার রয়েছেন।

বুধবারের ভোটে সোনামুখীর সাহাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৭ নম্বর বুথে ঢুকে ভোটকর্মীদের মেরে বের করে দিয়ে বুথের দখল নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল দীপালিদেবী এবং তাঁর অনুগামীদের বিরুদ্ধে। দীপালির নামে সরকারি কাজে বাধাদান (৩৩৩ ধারা), সরকারি কর্মীদের উপরে হামলা ও মারধর (৩৫৩), দল বেঁধে হামলা চালানো (১৪৭)-সহ বিভিন্ন জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু হয়েছে। পাশাপাশি ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ১২৩ ধারাতেও মামলা করা হয়েছে। বাঁকুড়ার জেলার রিটার্নিং অফিসার তথা জেলাশাসক বিজয় ভারতী

গোটা ঘটনার রিপোর্ট পাঠিয়েছেন কলকাতায় মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের অফিসে। রিপোর্টে তিনি বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ওই বুথে পুনর্নির্বাচনের সুপারিশ করেছেন। কলকাতা থেকে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের কাছে সেই রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে।


ক্লিক করুন..

বুথের প্রিসাইডিং অফিসার সুখেন্দু রজক এফআইআরে লিখেছেন, বুধবার বিকেলে ভোট চলাকালীন জনা ২০ সঙ্গীকে নিয়ে চড়াও হন দীপালিদেবী। বুথের দরজা বন্ধ করে ভিতরে থাকা প্রিসাইডিং অফিসার, সেক্টর অফিসার-সহ অন্য ভোটকর্মীদের মারধর করা হয় তাঁর উপস্থিতিতে। নির্বাচন কমিশনের ফটোগ্রাফার গণ্ডগোলের ভিডিও রেকর্ডিং করছিলেন। তাঁর ক্যামেরা হামলাকারীরা ছুড়ে ফেলে দেয় বলে অভিযোগ। তাদের এক জন ইভিএমে গিয়ে ভোট দিতে থাকে। মোট ৫৮টি ছাপ্পা ভোট মারা হয়। বুথ পাহারায় ছিলেন রাজ্য পুলিশের দুই সশস্ত্র কর্মী ও এক জন এনভিএফ। সুখেন্দুবাবুর দাবি, ওই তিন জনকে ঘেরাও করে রেখে দিয়েছিল দীপালির দলবল। সিপিএমের পোলিং এজেন্ট ছাপ্পা ভোটের প্রতিবাদ করায় তাঁকেও মারধর করে বুথ থেকে বের করে দেওয়া হয়। মিনিট দশেক বুথে থাকার পর সঙ্গীদের রেখে চলে যান বিধায়ক। ওই ঘটনার জেরে এখনও আতঙ্কে রয়েছেন সুখেন্দুবাবু। তাঁর কথায়, “বুথের মধ্যে হামলা, রিগিংয়ের কথা এত দিন শুনে এসেছি। নিজে যে সেই অভিজ্ঞতার সামনে পড়ব, স্বপ্নেও ভাবিনি!”

ঘটনার সময় কেন ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি, সেই প্রশ্ন করলে বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রের রিটার্নিং অফিসার তথা বাঁকুড়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক পার্থ ঘোষ দাবি করেন, “বুথের পরিবেশ উত্তপ্ত বুঝে দিনভর দফায় দফায় বিডিও, সেক্টর অফিসারেরা সেখানে গিয়েছেন। কিন্তু এত দ্রুত ঘটনাটি ঘটে গিয়েছে যে, আমাদের কিছু করার ছিল না।” যদিও ফোনে দীপালি এ দিনও দাবি করেন, “আমি ওই বুথে যাইনি। প্রিসাইডিং অফিসার কেন মিথ্যা অভিযোগ করলেন, বুঝতে পারছি না।” তিনি বুথে ঢুকেছিলেন কি না, তার প্রামাণ্য তথ্য যে ক্যামেরায় থাকার কথা, সেটি অবশ্য এখন সোনামুখীর বিডিও বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের হেফাজতে আছে। বিডিও এ দিন বলেন, “রিটার্নিং অফিসারের নির্দেশ মতো ক্যামেরা আমাদের কাছে আছে। ওই ক্যামেরায় কী ফুটেজ আছে, তা খতিয়ে দেখা হবে।” এ ব্যাপারে তৃণমূলের বাঁকুড়া জেলা সভাপতি অরূপ খাঁ-র বক্তব্য, তাঁরা দলীয় ভাবে বুথ দখলের অভিযোগের তদন্ত করছেন। এখন এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।

প্রিসাইডিং অফিসারের অভিযোগ পেয়ে বুধবার রাতেই অবশ্য সাহাপুরের ১০ যুবককে পুলিশ গ্রেফতার করে। বৃহস্পতিবার বিষ্ণুপুর আদালতের বিচারক তাঁদের তিন দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। ধৃতেরা তৃণমূলের কর্মী-সমর্থক কি না, তা যদিও পরিষ্কার নয়। জেলা পুলিশের এক অফিসার বলেন, “ঘটনার সময় যে পুলিশকর্মীরা ওই বুথে ছিলেন, তাঁরাই ধৃতদের চিহ্নিত করে দিয়েছেন।” কিন্তু দীপালিদেবীকে কেন ধরা যায়নি, তার সদুত্তর মেলেনি জেলা পুলিশের কর্তাদের কাছ থেকে। একই ভাবে বুথে ঢুকে প্রভাব খাটানোয় অভিযুক্ত পুরুলিয়ার বলরামপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মণিকা মাহাতোর বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ করেনি পুলিশ-প্রশাসন। ফলে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ফের প্রশ্ন উঠেছে। ঠিক যেমন উঠেছিল, তৃতীয় দফার ভোটে আরামবাগেও।

আরামবাগের তিরোল গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় অন্যের হয়ে ভোট দেওয়ার অভিযোগ ছিলতৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য ঝর্ণা সিংহের বিরুদ্ধে। টিভি ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল বুথের ভিতরকার সেই ছবি। চাপে পড়ে ঝর্ণাদেবীকে পুলিশ ধরলেও তিনি জামিন পেয়ে যান। বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, মামলাটিকে লঘু করে দেখানোর জন্যই জামিনযোগ্য ধারা আনা হয়েছিল ঝর্ণার বিরুদ্ধে।

এ দিন বিকেলে থানাগড়ায় দীপালিদেবীর বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায়, সদর দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। কয়েক বার ডাকাডাকির পরে দরজা সামান্য ফাঁক করে এক বয়স্ক মহিলা বললেন, “আমি এ বাড়ির কাজের লোক। বিধায়ক বাড়িতে নেই। কোথায় গিয়েছেন বলতে পারব না।” এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা পুলিশের কোর্টেই বল ঠেলেছেন। জেলাশাসক বিজয় ভারতী বলেন, “ঘটনার তদন্ত বা গ্রেফতার পুলিশ করবে!” বিধায়ক কেন অধরা? প্রশ্ন শুনে জেলার পুলিশ পর্যবেক্ষক লালচাঁদ ভারতীর বক্তব্য, “এর জবাব দেওয়ার উপযুক্ত লোক আমি নই। এগুলো এসপি বলবেন।” বারবার চেষ্টা করা হলেও ফোন ধরেননি বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার। এসএমএস করেও উত্তর মেলেনি।

বিরোধীদের দাবি, শাসক দলের নেত্রী হওয়াতেই দীপালিদেবীকে পুলিশ ধরছে না। সিপিএমের জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্র বলেন, “শাসক দলের বিধায়ককে ধরার সাহসই নেই পুলিশের!” জেলা কংগ্রেসের কার্যকরী সভাপতি অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “শাসক দলের বিধায়ককে ধরতেই পারল না পুলিশ! কী চলছে এই রাজ্যে!”

(সহ প্রতিবেদন: দেবব্রত দাস ও শুভ্র মিত্র)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE