ব্যাঘ্রধারিণী। সজনেখালিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সামসুল হুদা
কলকাতা চিড়িয়াখানা থেকে ঝড়খালি পৌঁছেই হুঙ্কার ছেড়েছিলেন তিনি।
আশ্বিনের রাত ফুঁড়ে হেড়োভাঙার বাদাবন উঝিয়ে সেই হুঙ্কারে প্রচ্ছন্ন এক বার্তাও বুঝি ছড়িয়ে পড়েছিল‘বাঘ দর্শনে আসিতেছেন দিদি!’
চার-খুুঁটির উপরে রংচটা ত্রিপল। কোনাকুনি টাঙানো দু’টি আধ ময়লা হ্যাজাক ঘিরে অগুন্তি রাত-পতঙ্গের ভিড়। তার মাঝেই ব্যাঘ্র পুনর্বাসন কেন্দ্রের তারজালির বেড়ার ধারে পাহারায় বসেছেন বনকর্মীরা। সে রাতে বিড় বিড় করে তাঁদেরই এক জন বলে ফেলেছিলেন, ‘‘দিদি বাঘ দেখতে চান, তাই আনা হল জোড়া দক্ষিণ রায়। আর হ্যাপা বাড়ল আমাদের!”
মুখ্যমন্ত্রীর বাঘ দর্শনের ‘হ্যাপা’ সামাল দিতে মাঝ-অক্টোবরে চিড়িয়াখানার নিশ্চিন্ত আহার-বিশ্রামের ঘেরাটোপ থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ঝড়খালির নির্মীয়মাণ এনক্লোজারে। এক জনের ডান চোখের কর্ণিয়া ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। অন্য জন বেজায় দুবলা। তা হোক, বাঘ বলে কথা। আর দিদির হাতে পুনর্বাসন কেন্দ্র বিনা-ব্যাঘ্রে উদ্বোধন, কভি নেহি! নবান্নের অন্দরের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর বন-প্রীতির মান রাখতে, ১৯ অক্টোবরের ঝড়খালির পুনর্বাসন কেন্দ্রের উদ্বোধনের আগেই তড়িঘড়ি পাঠানো হয়েছিল তাদের। আলিপুর চিড়িয়াখানার হাসপাতাল থেকে ট্রাকে চাপিয়ে সটান তাদের ঠিকানা বদলে গিয়েছিল ঝড়খালিতে।
পরিবর্তনের পর, কলকাতাকে লন্ডন আর দার্জিলিংকে সুইৎজারল্যান্ডে বদলে দেওয়ার আশ্বাস ছিল তাঁর। পাশাপাশি ছিল, সুন্দরবনে ‘আফ্রিকান সাফারি’র প্রতিশ্রুতি। ঝড়খালির ওই পুনর্বাসন কেন্দ্রের উদ্বোধনের আগে ঘনিষ্ঠ মহলে মমতা তাঁর বাঘ দেখার ইচ্ছাও কবুল করেছিলেন বলে শোনা যায়। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলয়ের আধিকারিকেরা আর দেরি করেননি। ১৫ অক্টোবরই কলকাতা থেকে বাঘ দু’টিকে তুলে দেওয়া হয়েছিল ট্রাকে। গন্তব্য ঝড়খালি।
বন দফতরের এক কর্তা বলেন, “চিড়িয়াখানায় বাঘ দু’টি বেশ সুস্থ হয়ে উঠছিল। তা বলে এমন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় তাদের একেবারে সটান ঝড়খালিতে নিয়ে আসতে হবে?” পরিচিত এক প্রাণী চিকিৎসকও সতর্ক করছেন, “সুন্দরবন ওদের পুরনো ঠিকানা ঠিকই। তবে দীর্ঘ দিন সেই পরিবেশে না থাকার পরে, ফিরিয়ে আনার জন্য অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়টা বেছে নেওয়া ঠিক হয়নি।” কেন? তাঁর ব্যাখ্যা, ঋ
তু পরিবর্তনের ওই সময়ে অসুস্থ প্রাণীদের ঠান্ডা লেগে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে। এ ক্ষেত্রে তা ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। প্রশ্ন রয়েছে আরও। ঝড়খালির ওই পুনর্বাসন কেন্দ্রে একই সঙ্গে ‘মিনি জু’-এর সিলমোহর পড়েছে। সেখানে দর্শকদের জন্য ঠাঁই হবে বাদাবনের বিভিন্ন পশু-পাখির। কিন্তু অসুস্থ পশুকে চিড়িয়াখানায় রাখা যায়? ব্যাপারটি যে মোটেই ভাল হয়নি মনে করছেন সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের প্রাক্তন অধিকর্তা পি কে সেন। তিনি বলেন, “ওখানে কী হয়েছে তা ঠিক জানি না। তবে অসুস্থ বাঘকে যদি চিড়িয়াখানায় রেখে মানুষকে দেখানো ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে বলব এটা করাটা ঠিক হয়নি।”
কিন্তু ঝড়খালিতে চিড়িয়াখানা হবে, অথচ বাঘ নেই, মুখ্যমন্ত্রীর মান যাবে যে! বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, তাদের কাছে নবান্নের আব্দার ছিল একটাই ‘মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে বাঘ পাঠানো হচ্ছে তো!’ তাই পুনর্বাসনের স্বাচ্ছন্দ্যে থাকা বাঘ দু’টিকে তড়িঘড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঝড়খালিতে। কিন্তু এত করেও বিধি বাম। আচমকাই মুখ্যমন্ত্রীর অক্টোবরের সেই সফর বাতিল হয়ে গিয়েছিল। নবান্ন থেকে বরাভয় দেওয়া হয়, আপাতত সফর বাতিল হলেও খুব তাড়াতাড়ি ঝড়খালি যাবেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রচ্ছন্ন নির্দেশও যায় জেলা বন দফতরের কাছে, ‘বাঘের স্বাস্থ্য যেন ভেঙে না পড়ে।’ অতএব, প্রাণী চিকিৎসকদের ঘন ঘন আনাগোনা শুরু হয় ঝড়খালিতে। বাঘ-বাঘিনীর খাদ্য তালিকায় নিয়মিত পড়তে থাকে, ভেড়া কিংবা মোষের মাংস, জলে গুলে এগিয়ে দেওয়া হয় ভিটামিন। ঝড়খালির খাঁচার পাশে দাঁড়িয়েই এক জেলা কর্তাকে স্বগতোক্তির ঢঙে বলতেও শোনা যায়, “আর যাই হোক মুখ্যমন্ত্রীর দর্শনের আগে পর্যন্ত সুস্থ থেকো বাবা!” পেরিয়ে যায় নভেম্বর। মুখ্যমন্ত্রী সময় দিতে পারছেন না। ধীরে ধীরে ঠান্ডা পড়তে থাকে সুন্দরবনে। স্থানীয় প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “ঠান্ডা পড়ে যাচ্ছিল। আমাদের মাথায় তখন একটাই চিন্তা, মুখ্যমন্ত্রীর সফরের আগে বাঘ দু’টো যেন অসুস্থ হয়ে না পড়ে।’’ নিত্য নজরদারি চলে প্রাণী চিকিৎসকদের। আর এই প্রবল উদ্বেগের মধ্যেই বছর বারোর স্ত্রী বাঘটি আচমকাই নেতিয়ে পড়ে এক দিন। জেলা প্রশাসন জুড়ে শোরগোল পড়ে যায়। এক কর্তা বলেন,“বাড়ির কেউ অসুস্থ হলেও এত দুশ্চিন্তা হত না!”
সোমবার সেই উদ্বেগ ফুরিয়েছে। হাসিমুখেই উদ্বোধন পর্ব শেষে মুখ্যমন্ত্রীকে বলতেও শোনা যায়, ‘চল বাঘ দেখে আসি’। কর্তাদের সঙ্গে নিয়ে খাঁচার পাশে দাঁড়িয়ে গুন গুন করে দু কলি গেয়েও ওঠেন তিনি, ‘বাঘ মামা বাঘ মামা, তোর গায়ে নেই জামা!’ ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে কর্তাদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy