আটটি সংখ্যা। ৫০৫৭, ৫২-৫৩। বাষট্টি বছরের পুরনো একটা রেজিস্ট্রেশন নম্বর! মস্তিষ্ক থেকে এখনও যে নম্বরটা মুছে যায়নি, স্রেফ এই কারণেই হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সম্মান পেতে পারতেন তিনি। এ-ও সম্ভব!
আগামিকাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানেই ওই বিশেষ প্রাক্তনীকে ‘ডি-লিট’ দেবেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আসল খবর কিন্তু সেটা নয়। বরং তার পটভূমিকায় উঠে আসা ওই আট সংখ্যার ধাঁধা। এই গল্পটা বেশি কেউ জানেন না। কিন্তু ওই প্রাক্তনী নিজে যে দু’জনকে বলেছেন, অর্থাৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ দু’জনেই ভয়ঙ্কর রকম চমকেছেন। হ্যাঁ, আপাত সদানির্লিপ্ত মনমোহনও চমকেছেন।
চমকেছেন, ওই মানুষটির নাম প্রণব মুখোপাধ্যায় জেনেও। ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে থেকেই তাঁর আশ্চর্য স্মৃতিশক্তির অজস্র প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও। কারণ, ওই ছ’দশক পুরনো রেজিস্ট্রেশন নম্বর। এতটাও মনে রাখা সম্ভব!
সমাবর্তন অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা নিয়ে বৈঠকে ব্যস্ত ছিলেন সুরঞ্জনবাবু। প্রসঙ্গটা তুলতেই হেসে ফেললেন। বললেন, “উফ্! ওঁর দুর্ধর্ষ স্মৃতিশক্তি।” তারিখ মনে পড়ল না উপাচার্যের। তবে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতে কী হয়েছিল, সেটা বললেন।
রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্যদের নিয়ে তিন মাস অন্তর বৈঠক করেন প্রণববাবু। এমনই এক বৈঠকে সুরঞ্জনবাবুর সঙ্গে এ-কথা সে-কথার মাঝেই প্রণববাবু বলেন, “এত পড়াশোনা করলে কী হবে, কোনও মার্কশিট বা শংসাপত্রই নেই আমার কাছে।” কেন? “সেই যে ’৭৮-এর বন্যায় ঢাকুরিয়ার বাড়িটা ভেসে গেল, তার পর থেকেই এগুলোর হদিস নেই। ইন্টারমিডিয়েটে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তার পর বিএ, এলএলবি, দু’টো এমএ কোনও মার্কশিট বা সার্টিফিকেট নেই। আমি রাষ্ট্রপতি বটে, তবে শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রমাণের কোনও কাগজই দেখাতে পারব না।”
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শংসাপত্রের প্রতিলিপি বের করা এখন জলভাত। সুরঞ্জনবাবু অভয় দিয়ে বলেন, “আপনি অনেক আগেই ওগুলো পেতে পারতেন। শুধু শিক্ষাবর্ষ আর রেজিস্ট্রেশন নম্বরটা খুঁজেপেতে বের করুন। তা হলেই..।” কথা শেষ করতে পারেননি উপাচার্য। রাষ্ট্রপতি বলেন, “৫০৫৭, ৫২-৫৩।”
মানে?
“১৯৫২-৫৩ শিক্ষাবর্ষে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছিলাম। রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৫০৫৭।”
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে ছিলেন উপাচার্য। পরে বলেন, “ইন্টারমিডিয়েটের নম্বর মনে আছে, সেটা তবু বিশ্বাস হয়। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন নম্বর!”
সুরঞ্জনবাবু তখনই কথা দেন, শংসাপত্রগুলির ডুপ্লিকেট কপি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। আর প্রণববাবু হেসে বলেন, “তবে এটা ভাববেন না, রাষ্ট্রপতি হয়েছি বলে পড়াশোনাতেও ভাল ছিলাম। ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া তখন কঠিন ছিল। পঞ্চাশ শতাংশের মতো নম্বর পেয়েছিলাম।”
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে এই কথোপকথনের কথা পরে এক দিন রাইসিনা পাহাড়ে চায়ের আড্ডায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহনকেও বলেন প্রণববাবু। প্রথমে চোখ কপালে তুললেও তার পর কিছু ক্ষণ চুপ করে থাকেন মনমোহন। শেষে বলেন, “নাহ্! (আমার) রেজিস্ট্রেশন নম্বর তো দূর, স্নাতকোত্তরের নম্বরও মনে নেই!”
জাতীয় রাজনীতিতে দলমত নির্বিশেষে প্রণববাবুর ঘনিষ্ঠদের অনেকেই বলেন, “ওঁর স্মৃতিশক্তি হাতির মতো।” এক-এক জন এক-একটা মজার উদাহরণও দিতে পারেন।
যেমন, প্রথম বার লোকসভা ভোটে জিতেই যখন নিম্নকক্ষের নেতা নির্বাচিত হন প্রণববাবু, সংসদের অলিন্দে তাঁকে অভিনন্দন জানান পি চিদম্বরম। বলেন, “আপনিই প্রথম রাজনীতিক, যিনি প্রথম বার জিতেই লোকসভার নেতা হলেন (দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী)।” কিন্তু প্রণববাবু তো প্রণববাবুই। ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, “আমি অবশ্য প্রথম ব্যক্তি নই। অনেকটা এ রকমই হয়েছিল হ্যারল্ড উইলসনের ক্ষেত্রে। ১৯৪৫ সালে উনি প্রথম বার ভোটে জিতেই ব্রিটেনের সংসদীয় সচিব হয়েছিলেন। ’৬৪ সালে উনি প্রধানমন্ত্রী হন। পরে আবার ’৭৪ সালেও প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।”
প্রবীণ রাজ্য কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্যের কথায়, “ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ইতিহাস মনে রাখা তো ওঁর কাছে ছোটখাটো ব্যাপার। রাজনীতির শুরুতে বাংলা কংগ্রেসে যখন যোগ দিয়েছিলেন, সেই সময় কোন কেন্দ্রে কে প্রার্থী হয়ে কত ভোট পেয়েছিলেন, তা-ও অনায়াসে বলে দিতে পারেন।” এমনকী দেশের প্রথম বাজেট থেকে শেষতম পর্যন্ত সহস্র পরিসংখ্যান রাষ্ট্রপতির ঠোঁটের গোড়ায় জানাচ্ছেন প্রদীপবাবু কী বলা যায় একে?
মনস্তত্ত্ববিদ রাজ্যশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “এ রকম শ্রুতিধরের দৃষ্টান্ত কখনও-সখনও মেলে।” তাঁর মতে, এমন ক্ষমতার মূলত তিনটি কারণ হতে পারে এক, যাঁদের মস্তিষ্কের কোষগুলি খুবই উন্নত, তাঁরা বহু পুরনো ঘটনা বা পরিসংখ্যান সহজে মনে রাখতে পারেন। দুই, যে সব বিষয় মানুষ মনে রাখতে চায়, সচেতন ভাবেই তা অবচেতনে থেকে যায়। তবে কতটা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে মনে থাকবে, সেটা নির্ভর করে তার অগ্রাধিকারের উপরে। তিন, একে ‘রিমোট মেমোরি’ও বলা যেতে পারে। মনস্তত্ত্বে বলে, পুরনো দিন বা ছোটবেলার বিভিন্ন ঘটনার স্মৃতি বেশি স্থায়ী হয়। তার উপর কেউ যদি শ্রুতিধর হন, তিনি ছোটবেলার ঘটনা ভালই মনে রাখতে পারেন।
বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা মতিলাল ভোরা অবশ্য এ সব বিশ্লেষণে ঢুকতে চাইলেন না। তবে বললেন, “এটুকু বলতে পারি, প্রণববাবুর মতো স্মৃতিশক্তি কংগ্রেসে কারও দেখিনি। ওয়ার্কিং কমিটির ফি-বৈঠকে নিদেন পক্ষে এমন একটা নজিরের কথা তুলে ধরতেন যে, সকলেই হাঁ হয়ে যেত।” অনেকেই লালকৃষ্ণ আডবাণীর স্মৃতিশক্তির প্রশংসা করেন। তবে বিজেপি নেতারাও মেনে নিচ্ছেন, প্রণববাবুর মতো পরিসংখ্যান মনে রাখার ক্ষমতা বর্ষীয়ান এই বিজেপি নেতারও নেই।
এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির প্রতিক্রিয়া জানার সুযোগ মেলেনি। তবে রাইসিনা সূত্র বলছে, নিজের অদ্ভুত ক্ষমতার জোরে তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শংসাপত্রগুলি ফেরত পেয়েছেন, এটা ভেবে রাষ্ট্রপতিও খুশি। এর আগে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি-লিট দিতে চেয়েছে। রাজি হননি প্রণব। কিন্তু নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে ফেরাননি।
কাল সমার্বতন অনুষ্ঠানে এই ঘটনার কথা কি বলবেন রাষ্ট্রপতি? দেখা যাক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy