Advertisement
E-Paper

মার্কশিট আনতেও আতঙ্ক, নৈরাজ্যের আশঙ্কা বিমানের

রাজ্যে ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাসের বিবরণে এ বার যোগ হল উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ এক অষ্টাদশীর কাহিনি! বর্ধমানের কেতুগ্রামের মহুলা গ্রামে নিহত সিপিএম নেত্রী আসমিরা বিবির পরিবারের সঙ্গে এ দিন দেখা করতে গিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। গত ২১ মে রাতে বাড়িতেই ধারালো অস্ত্রের কোপে খুন হন আনখোনা পঞ্চায়েতের প্রাক্তন সদস্যা আসমিরা।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৪ ০৩:০১
আসমিরা বিবির ছেলেমেয়ের পাশে সূর্যকান্তরা। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

আসমিরা বিবির ছেলেমেয়ের পাশে সূর্যকান্তরা। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

রাজ্যে ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাসের বিবরণে এ বার যোগ হল উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ এক অষ্টাদশীর কাহিনি!

বর্ধমানের কেতুগ্রামের মহুলা গ্রামে নিহত সিপিএম নেত্রী আসমিরা বিবির পরিবারের সঙ্গে এ দিন দেখা করতে গিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। গত ২১ মে রাতে বাড়িতেই ধারালো অস্ত্রের কোপে খুন হন আনখোনা পঞ্চায়েতের প্রাক্তন সদস্যা আসমিরা। সিপিএমের অভিযোগ, ভোটের দিন বুথে ভোট-লুঠে বাধা দেওয়াতেই আসমিরাকে খুন করেছে তৃণমূল। নিহত আসমিরার মেয়ে নাহিদা সুলতানা এ বার আনখোনা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রায় ৬০% নম্বর পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন। এ দিন রাজ্যের বিরোধী দলনেতার কাছে নাহিদার অভিযোগ, “তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা আমাদের ভয় দেখাচ্ছে। বাড়ির বাইরে বেরোলে দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। ওদের ভয়ে আমি স্কুল থেকে মার্কশিট পর্যন্ত আনতে যেতে পারছি না!”

শাসক দলকে ভোট না দেওয়ার অপরাধে বাড়িতে লুঠপাট, এলাকাছাড়া করা, বিরোধীদের কার্যালয় দখল, গুলি চালিয়ে জখম করার মতো নানা অভিযোগ ইতিমধ্যেই উঠেছে। সন্ত্রাস-কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে শনিবারই সন্দেশখালি ঘুরে গিয়েছে বিজেপির কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল। অন্যত্র আক্রান্ত সমর্থকদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে প্রশ্ন শুনে এসেছে বিমান বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্টের প্রতিনিধি দল। প্রশ্ন উঠেছে, নেতারা ফিরে যাওয়ার পরে কর্মী-সমর্থকদের কে বাঁচাবে? রবিবার আক্রান্ত এলাকায় গিয়ে সূর্যকান্ত মিশ্রকে সেই প্রশ্নের সঙ্গে শুনতে হল অন্য আতঙ্কের কথাও।

আরামবাগে আক্রান্ত ফিরদৌসি বেগম বিমানবাবুদের যা বলেছিলেন, অনেকটা সেই সুরেই এ দিন মহুলার বাসিন্দা নজরুল শেখ বিরোধী দলনেতাকে সামনে পেয়ে বলেন, “আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আপনারা চলে গেলে আমাদের কে বাঁচাবে?” প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে বিরোধী দলনেতার পরামর্শ, “আপনারা এক সঙ্গে থাকুন। কেউ আক্রমণ করতে পারবে না।” একই সঙ্গে তিনি বলেন, “আক্রমণ করতে এলে মানুষ আর চুপচাপ বসে থাকবেন না। আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষা করার অধিকার আমাদেরও রয়েছে।” পুরো বিষয়টি রাজ্যপাল এবং স্বরাষ্ট্রসচিবকে লিখিত ভাবে জানাবেন বলেও গ্রামবাসীদের আশ্বাস দেন তিনি। পরে সূর্যবাবু গ্রামের পুলিশ ক্যাম্পে গিয়ে নাহিদা-সহ গ্রামের অন্য ছাত্রছাত্রীরা যাতে নিশ্চিন্তে স্কুলে গিয়ে মার্কশিট আনতে পারেন, তার ব্যবস্থা করতে বলেন। পুলিশ এ ব্যাপারে তাঁকে আশ্বস্ত করেছে। যদিও কেতুগ্রামের তৃণমূল নেতা তথা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জাহের শেখের দাবি, “ওই প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্যা খুনের ঘটনাটির সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ নেই। কেউ হুমকিও দিচ্ছে না। বরং এলাকায় যাতে অশান্তি বা সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি না হয়, সেই চেষ্টা করছি আমরা।”

বিমানবাবু-সূর্যবাবুরা বুঝতে পারছেন, আতঙ্ক যে জায়গায় পৌঁছেছে, সেখানে শুধু মাত্র এলাকায় গিয়ে আক্রান্তদের মৌখিক আশ্বাস দিলে বিশেষ কাজ হওয়ার নয়। সেই কারণেই ফ্রন্ট চেয়ারম্যান তথা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবু আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, প্রশাসন যদি কড়া হাতে হামলা-হুমকি বন্ধ না করে, তা হলে আক্রান্তেরাই নিজেদের পথ বেছে নেবেন। তাতে রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু থাকবে না, নৈরাজ্য বাধবে! বিমানবাবুর কথায়, “আরামবাগে আমরা বলেছি, আপনারা এক সঙ্গে প্রতিরোধ করুন। কিন্তু এ ভাবে তো চিরদিন চলতে পারে না!”

সন্ত্রাস বন্ধের দাবি নিয়ে আগামী ৯ জুন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যাবে বামফ্রন্টের ১২ জনের এক প্রতিনিধি দল। প্রশাসনের কাছে দাবি জানানোর উপরেই আপাতত নিজেদের কর্মসূচি সীমাবদ্ধ রাখলেও ভবিষ্যতে বড় ধরনের সংঘর্ষ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বাম নেতারা। বিমানবাবুর বক্তব্য, “এই ভাবে দীর্ঘ দিন চলতে পারে না। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ কী করবে? আমরা চাই না, কিন্তু ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে রাজ্য এগোবে!” একই সঙ্গে তাঁর হুঁশিয়ারি, “মানুষকে সেই দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য দায়ী থাকবে রাজ্যের শাসক দলই।” ভোটের পরে আজ, সোমবার থেকে আলিমুদ্দিনে সিপিএমের রাজ্য কমিটির বৈঠক বসছে। সন্ত্রস্ত কর্মী-সমর্থকদের পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টি সেখানেও আলোচনায় উঠবে।

তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব অবশ্য এ দিনও দাবি করেছেন, নির্বাচনোত্তর সংঘর্ষ বলে রাজ্যে কিছু হচ্ছে না। বরং, ভোটের পরে তৃণমূল কর্মীরাই আক্রান্ত হচ্ছেন। বর্ধমান, হুগলি, পশ্চিম মেদিনীপুর, নদিয়ায় তৃণমূলের কর্মী খুন হয়েছেন বলে দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি।

সন্দেশখালি ঘুরে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল জানিয়েছিল, তারা যে দেখল-শুনল, তা সর্বভারতীয় সভাপতি রাজনাথ সিংহের পাশাপাশি কেন্দ্রে সরকারি স্তরেও জানানো হবে। জাতীয় তফসিলি কমিশনের নজরেও আনা হবে। সেই সফরের সমালোচনা করে পাথর্বাবু বলেন, “দিল্লি থেকে এসে বাংলা ভাগের চেষ্টা করছে বিজেপি! দিল্লির জুজু দেখাচ্ছে। ওই জুজুতে ভয় পাই না! লোকসভা ভোটে ৩৪টি আসন পেয়েছি। মানুষ তৃণমূলের সঙ্গে রয়েছে।” তাঁর বক্তব্যের সময় পাশে ছিলেন মুকুল রায়।

পার্থবাবুর এমন মন্তব্যের জবাবে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের প্রতিক্রিয়া, “বিজেপি তো কাউকে ভয় দেখাচ্ছে না! নিজেরাই ভয় না পেলে ৩৪টা আসন পেয়েও কেউ এমন সন্ত্রাস করে? এই রকম ঔদ্ধত্য দেখাতে গিয়েই সিপিএমের বিনাশ হয়েছিল!” বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, “এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজেপি মিষ্টি বিলি করছে, বাজি ফাটাচ্ছে। আর রাজ্যে প্রথম একটা দল ৩৪ আসন পেয়েও মানুষকে আক্রমণ করছে!”

মুকুলবাবু শনিবারই দাবি করেছিলেন, রাজ্যে গণতন্ত্র আছে। তৃণমূলই বরং আক্রান্ত। পার্থবাবুও তার পুনরাবৃত্তি করেছেন শুনে বিমানবাবুর মন্তব্য, “ওঁরা যদি সত্যি বলেন, তা হলে আমি যা বলছি, সব মিথ্যা! আর যা নিজেরা দেখে এলাম, সব মায়া!” বাম নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন, শাসক দলের হামলা থেকে রক্ষা করার উপায় না দেখেই কর্মী-সমর্থকেরা বিজেপি-তে যাচ্ছেন। কিছু ক্ষেত্রে এই সাময়িক আশ্রয় নেওয়ায় বাম নেতাদেরও যে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় আছে, তার ইঙ্গিত মিলেছে আরএসপি-র নেতা ক্ষিতি গোস্বামীর কথায়। আরএসপি-র বর্ধমান জেলা সম্পাদক অঞ্জন মুখোপাধ্যায় রাজ্য নেতৃত্বকে চিঠি দিয়ে জানান, তিনি বিজেপি-তে যাচ্ছেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষিতিবাবু বলেন, “অঞ্জনবাবু বড় গাছে কাছি বেঁধেছেন! আসল লড়াই তৃণমূলের বিরুদ্ধে। শক্তিশালী দলে গিয়ে তিনি সে লড়াই চালাতে চান।” আরএসপি-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, বাম জমানায় সিপিএমের সঙ্গে সংঘর্ষ সামলেও অনেকে আরএসপি-র মতো ছোট দল করতেন। কারণ, সরকারে থাকায় কিছুটা রক্ষা পাওয়ার ভরসা ছিল। ক্ষমতাহীন বাম শরিক দলের কর্মী-সমর্থকেরা তৃণমূলের সার্বিক আক্রমণের মুখে বিজেপি-র কাছে আশ্রয় খুঁজছেন।

ketugram asmira bibi cpm tmc
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy