আদালতে শুনানির শেষ দিন পর্যন্ত রাজ্য সরকারের তরফে বরাবর দাবি করা হয়েছে, সারদা-কাণ্ডে এ রাজ্যে সিবিআই তদন্তের দরকার নেই। শেষ পর্যন্ত শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই তদন্তেরই নির্দেশ দেওয়ার পরে তাকে স্বাগত জানাল রাজ্য। মুখ্যমন্ত্রী তথা শাসক দলের সর্বোচ্চ নেত্রী দাবি করলেন, এই সিদ্ধান্তে তাঁদের কিছু যায়-আসে না! তিনি নিরাপদ, তাঁর দলও নিরাপদ।
কিন্তু মুখে এ কথা বললেও শাসক দলের অনেকেই বুঝতে পারছেন না, শেষ দফার ভোটে সারদা-রায় কতটা প্রভাব ফেলবে! তাঁদের অনেকেরই আশঙ্কা, সর্বোচ্চ আদালতের রায় দলকে শুধু অস্বস্তিতেই ফেলল না, এর ফলে নিজেদের গড়েও ভোটযুদ্ধ কঠিন হয়ে পড়ল।
আগামী সোমবার রাজ্যে পঞ্চম তথা শেষ দফার ভোট। এই পর্বে যে ১৭টি আসনে নির্বাচন, এক কথায় বললে বহরমপুুর বাদ দিয়ে বাকি সবই এখন তৃণমূলের গড়! ২০০৯ সালে এর মধ্যে ১৪টিই যায় তৃণমূলের হাতে। দু’বছর পরে বিধানসভা ভোটে এই অঞ্চলে তাদের শক্তি আরও বাড়ে। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটের সময় সারদা কেলেঙ্কারির প্রাথমিক ছায়াতে ওই এলাকায় শাসক দলের মুঠো আলগা হওয়ার ইঙ্গিত মিলেছিল। তার প্রমাণ পঞ্চায়েত সমিতির ফল।
এই ভোটে কী ভাবে প্রভাব ফেলতে পারে সারদা-তদন্তের রায়? যে যে জেলায় শেষ পর্বে ভোট আছে, তার মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদিয়া এবং পূর্ব মেদিনীপুরে সারদা-কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বহু মানুষ ও এজেন্ট ছড়িয়ে আছেন। বিরোধীরা মনে করছেন, হাওড়া ও হুগলিতে ভোটের আগে সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণা হলে সেখানেও তার প্রভাব পড়তে পারত। বস্তুত বিরোধীরা আশাবাদী, শেষ পর্বের ভোটে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ তৃণমূলকে বেকায়দায় ফেলবে। সুপ্রিম কোর্টে মামলার শুনানি চলাকালীন বারবার রাজ্যের সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা, পুলিশ তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করে ফেলছে বলে ধৃত সাংসদ কুণাল ঘোষের এবং লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে ইডি-র তদন্ত গতি পাওয়ামাত্র মুখ্যমন্ত্রী-সহ গোটা শাসক দলের নেতৃত্ব প্রবল কেন্দ্র-বিরোধী বিষোদগার এ সবই প্রেক্ষাপট তৈরি করে রেখেছিল। যাঁদের কিছু আড়াল করার নেই, তাঁরা এ ভাবে আদালতের ভিতরে এবং বাইরে সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করবেন কেন তৃণমূলের নেতানেত্রীরাই বিরোধীদের এই প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিয়েছেন। স্বভাবতই শেষ পর্বে ভোট দিতে যাওয়ার সময়ে সাধারণ মানুষের কাছে এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
স্মরণযোগ্য কালের মধ্যে এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গে একটা সাধারণ নির্বাচন হচ্ছে দুর্নীতির অভিযোগের ছায়ায়। অপশাসন, সন্ত্রাস, গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ এ সব প্রশ্ন বহু নির্বাচনেই ঘুরেফিরে এসেছে। কিন্তু সনিয়া গাঁধী, রাহুল গাঁধী থেকে নরেন্দ্র মোদীর মতো সর্বভারতীয় নেতা-নেত্রীরা বাংলায় এসে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে শাসক দলের বিরুদ্ধে তোপ দাগছেন এমন নির্বাচনী আবহ এ রাজ্যে বিরল। সারদা-কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার আগে থেকেই গত তিন বছরের নানা ঘটনা সনিয়া-মোদীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। কখনও সারদা-গোষ্ঠীর দেওয়া অ্যাম্বুল্যান্স মুখ্যমন্ত্রী জঙ্গলমহলে বিলি করেছেন। সারদা-গোষ্ঠী যখন একের পর চ্যানেল-কাগজ কিনে সংবাদ ব্যবসায় ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, শাসকদলের নেতানেত্রীরাই তার উপরে খবরদারি করেছেন। ওই সব সংবাদমাধ্যমের কোন পদে কে বসবেন, কী ভূমিকা পালন করবেন, সে সবই ঠিক করে দেওয়া হয়েছে শাসক দলের তরফে! দেখা গিয়েছে, সারদার গ্রুপ মিডিয়ার যিনি সিইও, তিনিই তৃণমূলের টিকিটে রাজ্যসভায় গিয়েছেন! কখনও আবার বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার রমরমা নিয়ে আলোচনার জন্য বিধানসভায় বিরোধীরা মুলতুবি প্রস্তাব আনলে শাসক-শিবিরের প্রবল বাধা সংঘর্ষে গড়িয়েছে। আহত হয়ে হাসপাতালে গিয়েছেন দুই বিরোধী বিধায়ক! এই সব ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই সারদার সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্ক নিয়ে জনমানসে নানা প্রশ্ন উঠেছে। আমজনতার এই ধারণা থেকেই মোদী মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছেন, “আপনি তো অপরাধী নন! তা হলে যারা চুরি করেছে, তাদের জেলে ভরছেন না কেন?” প্রতিক্রিয়ায় মোদীর জুুটেছে “কে তুই হরিদাস” জাতীয় কটাক্ষ!
এই রকম পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী শুক্রবার বহরমপুরে মন্তব্য করেছেন, “নির্বাচনের দু’দিন আগে সিবিআই করে ভাবছে, বিরাট ব্যাপার! আমার কী যায়-আসে?” মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি, “আমি তো গরিব মানুষের টাকা ফেরত দিচ্ছিলাম। এখন তুুমি দেবে!” মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শ্যামল সেন কমিশন গঠন করে প্রায় চার লক্ষ আমানতকারীর টাকা ফেরানো হয়েছে। সরকারি তহবিল থেকে তার জন্য প্রায় আড়াইশো কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এ বার টাকা ফেরানোর সেই দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সংস্থাকে নিতে হবে। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র কলকাতায় একই কথা বলার পাশাপাশি সিবিআই তদন্তের নির্দেশকে স্বাগত জানিয়েছেন।
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী মুখ্যমন্ত্রী-সহ শাসক দলের এই অবস্থানকে নাটক বলে কটাক্ষ করেছেন। তাঁর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী তো সততার মোড়কে সিবিআই তদন্তের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন! এখন আদালতের রায়ে তাঁর সমস্ত প্রতিরোধ খানখান হয়ে গিয়েছে!” একে তৃণমূল নেত্রীর পরাজয় বলে দাবি করে অধীর বলেন, সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের আড়াল করার চেষ্টা করছেন ‘মা-মাটি-মানুষে’র প্রতিনিধিরা এই ছবি রাজ্যের মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের বক্তব্য, “সব জেনেশুনেই তো উনি সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করছিলেন! কান টানলে মাথা আসে। আমরা চাই, মাথারা সামনে আসুক।” সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর বক্তব্য, নিজেদের দোষ ঢাকতেই সারদার টাকা ফেরানোর জন্য রাজ্য তহবিল গড়েছিল। বিরোধীদের যুক্তি, আমজনতার করের টাকায় প্রতারকদের দায় মেটানোর কথা মুখ্যমন্ত্রী ভেবেছিলেন প্রতারিতদের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য। এখন সিবিআই তদন্তের নির্দেশ জারি হওয়ার পরেও সেই টাকা ফেরতের বিষয়টিকে তিনি হাতিয়ার করতে চেয়েছেন।
রাজ্য সরকারের তদন্তের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বোঝাতে এ দিনই অমিতবাবু বলেন, তৃণমূল সাংসদকেও তো গ্রেফতার করা হয়েছে। অথচ ধৃত সেই সাংসদ কুণালই সংবাদমাধ্যমের কাছে সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন, সারদার টাকায় যাঁরা লাভবান হয়েছেন, তাঁদের আড়াল করছেন মুখ্যমন্ত্রী। পুলিশ তথ্যপ্রমাণ লোপাট করতে চাইছে। সিবিআইয়ের হাতে কুণাল পড়লে আরও কী কী তথ্য বেরিয়ে আসবে, তা ভেবে আশঙ্কায় শাসক-শিবিরের একাংশ। সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী তাই সুদীপ্ত সেন ও কুণালের প্রাণহানির আশঙ্কা করেছেন।
শাসক দলের এক প্রথম সারির নেতার আক্ষেপ, “বিষয়টা প্রথম থেকে আরও কৌশলে সামলাতে পারলে ভোটের মুখে এসে অস্বস্তি একটু এড়ানো যেত!” ওই নেতার বক্তব্য, আদালতে হলফনামা দিয়ে রাজ্যের আইনজীবী বলছেন, সিবিআই চাই না। আর মুখ্যমন্ত্রী পরে বলছেন, কিছু যায় আসে না! এই ‘দ্বিচারিতা’ ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। ইডি তৎপরতা শুরু করার পরে নির্বাচনী প্রচারেই তৃণমূল নেত্রী এবং দলের আর এক শীর্ষ নেতা মুকুল রায় এক-এক রকম কথা বলেছেন। তার চেয়ে শুরু থেকেই ‘আমরা যে কোনও তদন্তের জন্য প্রস্তুত’ বলা গেলে ভুল বার্তা যেত না বলে ওই নেতার মত।
শেষ পর্বের ভোটের আগে এখন সুযোগ পেয়ে কংগ্রেসের শশী তারুর থেকে বিজেপি-র প্রকাশ জাভড়েকরের মতো জাতীয় স্তরের নেতা, কংগ্রেসের প্রদীপ ভট্টাচার্য থেকে বিজেপি-র রাহুল সিংহের মতো রাজ্য স্তরের নেতা, সকলেই বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছেন। আর মূূলত যাঁর উদ্যোগে সারদা মামলা সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল, সেই কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান দাবি করেছেন, “আদালতকেও রাজ্য সরকার তথ্য গোপন করে ও ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। মুখ্যমন্ত্রী এত দিন ধরে সিবিআই করতে না দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের প্রমাণ লোপাটের সুযোগ করে দিয়েছেন। তাঁর বাংলার মানুষের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত! তাঁর উচিত ইস্তফা দেওয়া।” পাশাপাশি কলকাতার প্রাক্তন মেয়র ও আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, “উনি বিনা পারিশ্রমিকে সুপ্রিম কোর্টের বাঘা বাঘা আইনজীবীকে সামলেছেন!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy