অস্বস্তি যেন পিছু ছাড়ছে না!
মাস কয়েক আগে কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল নিজেকে ‘চন্দননগরের মাল’ বলে নাকাশিপাড়া এলাকায় গিয়ে হুমকি দিয়েছিলেন, “একটা কেউ বিরোধী মস্তানি করতে আসে, আমাদের ছেলেদের ঢুকিয়ে রেপ করে দেব।” এলাকার সাংসদের সেই কুকথার অস্বস্তি আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি জেলা তৃণমূল। সাংসদের হয়ে ‘সাফাই’ গাইতে গাইতেই কৃষ্ণগঞ্জের ঘুঘড়াগাছির ঘটনায় ফের একবার ‘মুখ পুড়ল’ তৃণমূলের।
গত রবিবার ঘুঘড়াগাছিতে ২২ বিঘা জমি দখলকে কেন্দ্র করে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হয়েছিলেন এক মহিলা। জখম হয়েছেন আরও তিন জন। সেই ঘটনায় অন্যতম মূল অভিযুক্ত লঙ্কেশ্বর ঘোষ ওরফে লঙ্কা-সহ অন্যান্য দুষ্কৃতীদের মদতদাতা হিসাবে নাম জড়িয়ে পড়েছে কৃষ্ণগঞ্জ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি লক্ষ্মণ ঘোষচৌধুরীর। যার নিট ফল, জেলা তৃণমূল ফের অস্বস্তিতে।
ঘুঘড়াগাছির ঘটনার পরে লঙ্কা নিজেকে তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী বলে দাবি করেছিলেন। বলেছিলেন, “নেতারাও আমাকে চেনেন। এতে দোষের কী আছে!” সেই অস্বস্তি ঢাকতে ঘটনার দিনই লক্ষ্মণবাবুর প্রতিক্রিয়া ছিল, “জমি দখলকে কেন্দ্র করে যাঁদের নাম উঠে আসছে তাঁদের মধ্যে লঙ্কাকে আমি চিনি। তবে লঙ্কা তো গরু পাচারকারী, সমাজবিরোধী। তাই তাঁকে আমাদের দলের কাছাকাছি ঘেঁষতে দিইনি।” যা শুনে বিস্মিত ঘুঘড়াগাছি তো বটেই, খোদ লঙ্কাও আকাশ থেকে পড়েছিলেন।
এরপর দলীয় ভাবে যতই লঙ্কা-লক্ষ্মণ যোগ অস্বীকার করে ‘সাফাই’ দেওয়া হয়েছে, ততই তৃণমূলের ঘরে-বাইরে অস্বস্তি আরও বেড়েছে বই কমেনি। ঘটনার পরে জেলা নেতৃত্ব এই ‘কঠিন সময়ে’ একসঙ্গে কাজ করার বার্তা দিলেও লক্ষ্মণবাবুর বিরোধী গোষ্ঠী কিন্তু তাঁকে এড়িয়ে চলছে বলেই দলীয় সূত্রে খবর। এই অবস্থায় ব্লক রাজনীতিতে লক্ষ্মণবাবু যে ক্রমশ ‘নিঃসঙ্গ’ হয়ে পড়ছেন সে কথা কবুল করছেন লক্ষ্মণবাবুর অনুগামীরাও।
আর ঠিক এখান থেকেই দলের অন্দরে প্রশ্নটা উঠছে যে, লক্ষ্মণবাবুর অবস্থাও কি তাপস পালের মতোই হতে চলেছে? মাস কয়েক আগে নাকাশিপাড়া ও তেহট্টের একাধিক গ্রামে কুকথার ঝড় তুলেছিলেন সাংসদ-অভিনেতা তাপস পাল। ঘটনার পরে দলের অনেকেই তাঁর প্রকাশ্যে নিন্দা করেছিলেন। জেলার বৈঠকেও তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। সাংসদের পাশে যে কেউ নেই, সে কথা প্রকাশ্যে জানিয়েও দিয়েছিলেন অনেকে। এ ভাবেই নিজের কেন্দ্রে ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন সাংসদ। সেই ঘটনার পর থেকে আজ পর্যন্ত তাপসবাবু তাঁর কেন্দ্র, কৃষ্ণনগরে পা রাখেননি। আর ঘুঘড়াগাছির ঘটনার পরে পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে তাতে অনেকেই মনে করছেন যে, তাপস পালের মতো একই পরিণতি হবে লক্ষ্মণবাবুরও।
লক্ষ্মণবাবুর বিরোধী গোষ্ঠীর লোক বলে পরিচিত কৃষ্ণগঞ্জ এলাকার এক তৃণমূল নেতা বলেন, “এত দিন লক্ষ্মণবাবু যে ভাবে ব্লকে দলটা চালাচ্ছিলেন তাতে এমনিতেই তাঁর উপরে সাধারণ কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিলেন। তার উপরে ঘুঘড়াগাছির ঘটনায় লঙ্কার মতো একটা দুষ্কৃতীর সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে পড়ায় ব্লকের কর্মীরাও সেটা মেনে নিতে পারছেন না। এই মহূর্তে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস না পেলেও তাঁরাও কিন্তু ভিতরে ভিতরে ফুঁসছেন। লক্ষ্মণবাবুর পাশ থেকে একে একে অনেকেই সরে যেতেও শুরু করেছেন।”
এই নেতার কথা যে শুধু কথার কথা নয় তা কিন্তু টের পাওয়া গিয়েছে লক্ষ্মণবাবুর বুধবার বিকেলে ডাকা পথসভাতেও। ঘুঘড়াগাছির ঘটনা নিয়ে কৃষ্ণগঞ্জের মাজদিয়া বাজারের ওই সভায় ছিলেন না তৃণমূলের প্রাক্তন দুই ব্লক সভাপতি। দলীয় সূত্রে খবর, মুষ্টিমেয় কয়েক জন অনুগামীকে নিয়ে সভা করে লক্ষ্মণবাবু ঘুঘড়াগাছি কাণ্ডে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেন। ওই সভায় তাঁর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর কাউকেই তিনি ‘পাশে’ পাননি। প্রাক্তন ব্লক সভাপতি প্রণব বিশ্বাস কিংবা কল্যাণ চক্রবর্তীরা জানিয়েছেন যে, তাঁরা অন্য জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকায় ওই সভায় যেতে পারেননি। তবে প্রাক্তন ওই দুই ব্লক সভাপতির ঘনিষ্ঠরা জানান, যে ভাবে লক্ষ্মণবাবুর সঙ্গে লঙ্কার নাম জড়িয়ে গিয়েছে, তাতে অনেকেই তাঁর থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছেন।
শুক্রবার বিকেলে কৃষ্ণগঞ্জের জঘাটায় জেলা তৃণমূলের সভায় আবার সব নেতাকে এক মঞ্চে তুলে ‘একতার’ বার্তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই বার্তা যে কতটা কাজে দেবে তা নিয়েও সংশয় রয়ে গিয়েছে দলের অন্দরেই। লক্ষ্মণবাবুর সঙ্গে লঙ্কার নাম জড়িয়ে যাওয়ায় রীতিমতো ক্ষুব্ধ তৃণমূলের সাধারণ কর্মী সমর্থকরাও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য বলছেন, “আমরা অনেক কষ্ট করে সিপিএমের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে দলকে এই এলাকায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছি। সেটা এ ভাবে নষ্ট হতে দেখে আজ সত্যিই কষ্ট হচ্ছে। যে জমির জন্য আন্দোলনের কথা বলে আমরা মানুষের কাছে এত দিন ভোট চেয়ে এসেছি, আর আজ সেই জমি রক্ষা করতে গিয়ে গ্রামের এক মহিলার মৃত্যু হল! আর সব চাইতে লজ্জার কথা লঙ্কার মতো একজন সমাজবিরোধীর সঙ্গে নাম জড়িয়ে গিয়েছে আমাদেরই ব্লক সভাপতির। বলতে পারেন, আজ মানুষের কাছে কী জবাব দেব?”
তবে এসব কিছুই গায়ে মাখতে রাজি নন জেলা নেতৃত্ব। তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত বলেন, “আমাদের দলে কোনও বিভাজন নেই। নেই কোনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও। যার প্রমাণ গতবারের বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচন। এ বারেও তার অন্যথা হবে না।”
আর গ্রামবাসীরা কী বলছেন? ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীদের একাংশ বলছেন, “যা বোঝার আমরা বুঝে গিয়েছি। তার জবাব এই এলাকার মানুষ আগামী বিধানসভার উপনির্বাচনেই দেবেন।” তাঁদের কথায়, “ঘুঘড়াগাছির এই ঘটনায় তৃণমূলের উপরে এলাকার মানুষ বীতশ্রদ্ধ। ঘটনার পর থেকে আজ পর্যন্ত একটি বারের জন্যও তৃণমূলের কোনও নেতা গ্রামে আসেননি। খোঁজ নেননি কেমন আছেন নিহত ও আহতদের পরিবারের সদস্যরা। গত শুক্রবার যে সভাটি তৃণমূল করেছে সেটাও গ্রামের বাইরে, জঘাটা এলাকায়। সেখানে বলতে গেলে গ্রামের তেমন কেউই যাননি। ওরা সভা ভরিয়েছে বহিরাগতদের দিয়ে। এটা আমরা ভাল ভাবে নিইনি। তার জবাবও আমরা দেব। ঠিক সময়ে। দেখে নেবেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy