যত সময় যাচ্ছে, খোলা বাজারে ধানের দাম পড়ছে। অথচ এখনও সহায়ক মূল্যে ধান কেনায় গতি আনতে পারছে না রাজ্য সরকার।
প্রান্তিক চাষিদের অভাবী বিক্রি রুখতে প্রতি বছরই চালকল এবং বিভিন্ন সরকারি সংস্থা মারফত ধান কেনে রাজ্য। এ বছর ভাল ফলন হয়েছে। কিন্তু এখনও তেমন ভাবে ধান কেনা শুরু করেনি খাদ্য ও সরবরাহ দফতর। সেই সুযোগে পাইকার ও ফড়েরা ইতিমধ্যেই প্রচুর ধান কিনে গুদামে মজুত করেছে। আর তার পর থেকেই খোলা বাজারে দাম পড়তে শুরু করেছে।
গত বার এ জেলায় ৮০ লক্ষ মেট্রিক টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল সরকারের। এ বার তা কমিয়ে ৬৭ লক্ষ মেট্রিক টন করা হয়েছে। ফলে সরকারের তাগিদও কম। চাষিদের অভিযোগ, এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন এক শ্রেণির পাইকার। নানা অজুহাতে তাঁরা ন্যায্য দাম দিতে চাইছেন না। কখনও বলছেন, ভাল করে ধান শুকোনো হয়নি। কখনও বলছেন, এই ধান চাল করতে গেলেই ভেঙে যাবে। পরের চাষ করতে গেলে চাষিদের পক্ষে ঘরে ধান জমিয়ে বসে থাকা সম্ভব নয়। বাধ্য হয়েই তাঁদের কম দামে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে।
সরকারি সহায়ক মূল্য কুইন্ট্যাল ১৩৬০ টাকা, অর্থাৎ ১৩.৬০ টাকা কেজি। কিন্তু রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় ধানের বিভিন্ন রকম দাম চলছে। ধান যখন প্রথম উঠল তখন প্রায় ১৫০০ টাকা, পরে তা কমে ১৪০০ টাকার আশপাশে ছিল। কিন্তু এ বার ধানের ফলন ভাল হওয়ায় দ্রুত খোলাবাজারে দাম কমতে শুরু করে। বর্ধমানের বিস্তীর্ণ এলাকায় এখন ৬২ কেজির বস্তা পিছু ৭৩০-৭৫০ টাকা, অর্থাৎ খুব জোর কেজিতে ১২ টাকা দর পাচ্ছেন চাষিরা। হুগলিতে দাম নেমেছে সাড়ে ১১ টাকায়, চাষিরা ৬০ কেজির বস্তা বিক্রি করছেন ৬৭০-৬৯০ টাকায়। পশ্চিম মেদিনীপুরে পরিস্থিতি আরও খারাপ। খোলা বাজারে কমবেশি ১০৫০ টাকা কুইন্ট্যাল, অর্থাৎ কেজিতে সাড়ে ১০ টাকায় ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন চাষিরা।
এই সময়ে চাষিদের জোরকদমে আলু এবং সব্জি চাষে নেমে পড়ার কথা। ধান বিক্রি করেই চাষিদের আলু বীজ, সার কিনতে হয়। ধানের টাকাতেই পৌষ পার্বণ হয়। সেই সুযোগটাই নিচ্ছেন একশ্রেণির পাইকার ও ফড়েরা। শালবনির চাষি দুর্গাপ্রসাদ বাস্কের কথায়, “রাসায়নিক সার, কীটনাশক-সহ চাষের যাবতীয় উপকরণের দাম বাড়ছে। অথচ ধানের দাম সেই অনুপাতে বাড়ছে না। ব্যবসায়ীরা ১০৫০ টাকার বেশি দরে ধান কিনতেই চাইছেন না।” একই বক্তব্য মেদিনীপুর সদর ব্লকের চাষি সূর্যকান্ত ঘোষের। এ দিকে রাসায়নিক সার, কীটনাশকের দাম, শ্রমিকদের মজুরি, সবই বেড়েছে। ক্ষতির বোঝা বইতে হচ্ছে সাধারণ চাষিদের। হুগলির পাণ্ডুয়া এলাকার চাষি আব্দুল কাশেম বলেন,“আমি যে পরিমান ধান চাষ করেছিলাম তার কিছুটা অভাবি বিক্রিতে বাধ্য হয়েছি। না হলে এবার হাতে আলুর চাষের টাকা ছিল না।” ওই জেলারই দাদপুর এলাকার চাষি হরপ্রসাদ মালিক বলেন,“আমাদের এলাকায় বেশির ভাগ চাষিই অভাবী বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছেন। আমি সমবায় ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে কোনও ক্রমে সামাল দিয়েছি। এখন অপেক্ষায় রয়েছি, যদি ধানের দাম কিছুটা ওঠে।”
কিন্তু চাষিদের বড় অংশেরই আশঙ্কা, সরকার এখনও সে ভাবে ধান কিনতে না নামায় খোলাবাজারে ধানের দাম আরও পড়বে। কেন হচ্ছে না ধান কেনার শিবির? খাদ্য ও সরবরাহ দফতর সূত্রের খবর, সরকার ধান কেনে দু’ভাবে। বেশির ভাগটা কেনা হয় বিভিন্ন চালকল মারফত। বেনফেড-এর মতো কিছু সংস্থাও সরাসরি শিবির করে কিছুটা ধান কেনে। ওই সংস্থাগুলি ইতিমধ্যে কিছু শিবির করেছে।
কিন্তু চালকল মালিকদের বেশির ভাগই সরকারের হয়ে ধান কিনতে উৎসাহী নন। কেননা, এই বাবদ গত বারের বকেয়াই এখনও অনেকটা বাকি। হুগলির কলমালিকদের সরকারের থেকে পাওনা ৮০ কোটি টাকা। বর্ধমানের পাওনা ১০০ কোটি ছাড়িয়েছে। ডিস্ট্রিক্ট কন্ট্রোলার অফিস থেকে অবশ্য আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, আর কিছু দিনের মধ্যেই বকেয়া মিটিয়ে দেওয়া হবে। এক চালমিল মালিকের কথায়,“সরকারি টাকা হাতে এলেই ধান কেনার শিবির বাড়বে। তাতে খোলাবাজারে দাম পড়াটা আটকাবে।”
এর পরে শিবির হলেও কি আখেরে প্রান্তিক চাষিদের লাভ হবে?
পশ্চিমবঙ্গ ধান্য ব্যবসায়ী সমিতির বর্ধমানের এক সদস্যের দাবি, ইতিমধ্যেই তাঁরা বিপুল পরিমাণ ধান কিনে মজুত করে ফেলেছেন। প্রান্তিক চাষিদের হাতে খুব বেশি ধান নেই। এর পরে ধান কিনতে হলে সরকারকে তাঁদের কাছ থেকেই কিনতে হবে। কিন্তু সরকার যখন ধানকল বা ধান কেনে, তখন পঞ্চায়েত থেকে ‘চাষি শংসাপত্র দেখাতে হয় বিক্রেতাদের। ধান্য ব্যবসায়ীরা তা দেখাবেন কী করে? ধান বিক্রি বাবদ চেকই বা হাতে পাবেন কী করে? বহু এলাকাতেই কথা বলা জানা গিয়েছে, প্রান্তিক চাষিরাই পঞ্চায়েত থেকে শংসাপত্র তুলবেন। তাঁদের সামনে রেখে ধান বিক্রি করবেন পাইকারেরা। চাষিদের নামেই চেক হবে। তা ভাঙিয়ে চাষিরা পাইকারদের নগদ টাকা দিয়ে দেবেন। পূর্বস্থলীর এক চাষি বলেন, “এই ব্যবস্থা মেনে না মিলে প্রয়োজনের সময় ধান বিক্রি করে নগদ টাকা হাতে পাওয়ার আর কোনও রাস্তা ছিল না।”
তবে সবাই যে সব ধান বেচে দিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলেছেন, তা-ও নয়। প্রান্তিক চাষিদের একাংশ এখনও কিছু ধান বাঁচিয়ে রেখেছেন। তুলনায় স্বচ্ছল কিছু চাষির ঘরেও উদ্বৃত্ত ধান রয়েছে। রাজ্য সরকার দ্রুত ধান কিনতে নামলে এঁরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন, সন্দেহ নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy