Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

শিমুলিয়ায় জঙ্গি প্রশিক্ষণের কথা কবুল খানসার

গ্রামের মেয়ে, শহর চেনে না বললেই চলে। বয়স মাত্র ২৩। বাপের বাড়ি আর স্বামীর ঘরের ঘেরাটোপে কেটেছে জীবনের প্রায় সবটা। পড়াশোনা সামান্যই। সেই মেয়েই রীতিমতো চমকে দিয়েছে তুখোড় গোয়েন্দাদের। তাঁদের চোখা চোখা প্রশ্নের উত্তর নিপুণ ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে খানসা বিবি। কতটুকু বলতে হয়, কোথায় থামতে হয়, কখন কথা ঘোরাতে হয়, কিছুই তার অজানা নয়।

গৌরব বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৩০
Share: Save:

গ্রামের মেয়ে, শহর চেনে না বললেই চলে। বয়স মাত্র ২৩। বাপের বাড়ি আর স্বামীর ঘরের ঘেরাটোপে কেটেছে জীবনের প্রায় সবটা। পড়াশোনা সামান্যই। সেই মেয়েই রীতিমতো চমকে দিয়েছে তুখোড় গোয়েন্দাদের। তাঁদের চোখা চোখা প্রশ্নের উত্তর নিপুণ ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে খানসা বিবি। কতটুকু বলতে হয়, কোথায় থামতে হয়, কখন কথা ঘোরাতে হয়, কিছুই তার অজানা নয়।

নদিয়ার থানারপাড়া গমাখালির জহিরুল শেখের স্ত্রী খানসা বিবি রীতিমতো অবাক করে দিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশকে। এর আগে খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডে ধৃত রাজিয়া ও আলিমা বিবিকে জেরা করতে গিয়েও অবাক হয়েছিলেন জাতীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) অফিসাররা। তাঁদের দাবি, হাজার চাপের মুখেও ভেঙে না পড়ার প্রশিক্ষণ বহু আগেই নিয়ে রেখেছে এই প্রমিলা বাহিনী।

খাগড়াগড় বিস্ফোরণে হত শাকিল আহমেদের পরিবারকে জেরা করে থানারপাড়ার গমাখালির জহিরুল ও তার স্ত্রী খানসার নাম উঠে আসে। ১০ অক্টোবর জহিরুলের বাড়ি থেকে সিআইডি ৪১টি জিলেটিন স্টিক উদ্ধার করে। উদ্ধার হয় একটি ডায়েরিও। সেই ডায়েরির পাতায় পাতায় খানসার নিজের হাতে লেখা রয়েছে ‘রক্ত’, ‘জেহাদ’, ‘হাতে তুলে নাও তরোয়াল, একে ৪৭’ এ মতো শব্দ ও বাক্য। গত ২৪ অক্টোবর করিমপুরের বারবাকপুরে খানসার বাবার বাড়িতে গোয়েন্দাদের প্রশ্নের উত্তরে খানসা কবুল করে, হাতের লেখা তারই। তবে কথাগুলো গজলের বাছাই করা শব্দ।

খাগড়াগড় বিস্ফোরণের দিনকয়েক পর থেকে জহিরুল উধাও। তার আত্মীয়দের সঙ্গে আলাদা আলাদা ভাবে কথা বলেন গোয়েন্দারা।

সেই তথ্য যাচাই করতে বুধবার বিকেলে জহিরুলের শ্বশুর-শাশুড়ি, মা-বাবা এবং স্ত্রী খানসাকে থানারপাড়া থানায় নিয়ে আসেন গোয়েন্দারা। সেখানে প্রায় চার ঘণ্টা জেরা করে গোয়েন্দারা যা তথ্য পেয়েছেন, তাতে শিমুলিয়ার মাদ্রাসার সঙ্গে জাহিরুল-খানসার সম্পর্কের নতুন ছবি উঠে এসেছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ২৪ অক্টোবর খানসা গোয়েন্দাদের জানিয়েছিল যে, সে শিমুলিয়ায় মাদ্রাসায় গিয়েছিল। তবে সেটা বিয়ের আগে না পরে, তা স্পষ্ট করেনি। বুধবার বিকেলে টানা জেরায় সে স্বীকার করেছে, বিয়ের আগেই সে শিমুলিয়ায় গিয়েছিল। তার সঙ্গে জহিরুলের বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয় সেখানেই। নদিয়ার যে ব্যক্তি খানসাকে শিমুলিয়া মাদ্রাসাতে নিয়ে গিয়েছিল, সে-ই জহিরুল-খানসার বিয়ের মধ্যস্থতা করে (তদন্তের স্বার্থে কর্মসূত্রে ওই ভিন্দেশির নাম গোপন রাখছেন গোয়েন্দারা)। নদিয়ার এই ব্যক্তিও খাগড়াগড়-কাণ্ডের অন্যতম ‘মাস্টার মাইন্ড’ বলেই দাবি গোয়েন্দাদের।

এনআইএ খাগড়াগড় কাণ্ডে জড়িত যে সাজিদের জন্য ১০ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে, সেই সাজিদের স্ত্রী ফতিমা শিমুলিয়ার মাদ্রাসাতে মহিলাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিত বলে গোয়েন্দাদের জানিয়েছে খানসা। কী কী প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো তা নিয়ে অবশ্য মুখ খোলেনি খানসা। তবে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দাদের ধারণা, ওই মেয়েদের গুলি ছোড়া, শারীরিক কসরৎ শেখানো এবং জেহাদি ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করাই ছিল ফতিমার কাজ।

ইতিমধ্যে এ রাজ্যের লালগোলার একটি অনুমোদনহীন মাদ্রাসা থেকে রাজ্যের মহিলা জেহাদি প্রশিক্ষণের একটি ভিডিও ফুটেজ হাতে পেয়েছে গোয়েন্দারা। তা থেকে স্পষ্ট যে, খাগড়াগড় কাণ্ডে যাদের নাম উঠে এসেছে তাদের প্রায় সকলেই খাগড়াগড় কাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির বছর তেইশের অত্যন্ত ‘সাধারণ মেয়ে’ খানসা যে ভাবে গোয়েন্দাদের চোখা চোখা প্রশ্ন সামলাচ্ছে, এবং ‘ঠিক সময় মতো’ প্রসঙ্গ বদলে ফেলছে তাতে বিস্মিত গোয়েন্দারা। বুধবারের জেরাতে প্রথম দিকে খানসা সব প্রশ্নের উত্তরই ‘না’ কিংবা ‘জানি না’ দিয়েই সারছিল। তারই গ্রামের পড়শি মেয়ে রাজিয়ার ছবি দেখেও চিনতে পারছিল না খানসা। পরে অবশ্য সে নদিয়ার ওই ব্যক্তি, সাজিদের স্ত্রী ফতিমা ও জঙ্গি প্রশিক্ষণের কথা স্বীকার করে।

অসঙ্গতি কোথায়? গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, খানসা গোয়েন্দাদের জানিয়েছিল যে, ঈদের সময় সে জহিরুলের সঙ্গে গমাখালিতে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিল। ঈদের পরে (৭ অক্টোবর) জহিরুল ‘কাজে’ চলে গেলে সে তার মায়ের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বারবাকপুরে বাপের বাড়িতে চলে আসে। কিন্তু এ দিন মুখোমুখি সবাইকে বসিয়ে জেরা করার সময় জহিরুলের মা-বা গোয়েন্দাদের জানান যে, ঈদের পরে জহিরুল স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে মোটরবাইকে করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।

এতদিন দুই পরিবারের সকলেই বলছিলেন তাঁরা কেউই জহিরুলের খোঁজ জানে না। এ দিন অবশ্য গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসাবাদের পরে জহিরুল কোথায় আছে তা জানতে পেরেছে। তবে খানসা নিজে জহিরুল সম্পর্কে একটি তথ্যও গোয়েন্দাদের দেয়নি। বুধবার রাতে খানসা-সহ সকলকেই থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হলেও তাদের প্রত্যেকের গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে বলেই দাবি গোয়েন্দাদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

shimulia khagragarh blast khansar gaurab biswas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE