বিষ্ণুপুর আদালতে মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ছবি: শুভ্র মিত্র।
সরকারের যিনি মন্ত্রী, তিনিই লড়ছেন সরকারের বিরুদ্ধে!
সোমবার এমনই দৃশ্য দেখল বিষ্ণুপুর আদালত। যেখানে অভিযুক্ত রাজ্যের শাসক দলের এক বিধায়ক। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা দেওয়া, সরকারি কর্মীকে মারধরের অভিযোগ রয়েছে। সেই অভিযুক্তের হয়ে জামিন চাইতে এজলাসে কি না রাজ্যেরই মন্ত্রী!
এ দিন বাঁকুড়ার সোনামুখীর তৃণমূল বিধায়ক দীপালি সাহার হয়ে বস্ত্রশিল্প মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সওয়ালের ঘটনায় আইনজীবীদের একটা বড় অংশ যারপরনাই বিস্মিত। বেনজির এই কাণ্ড ঘটিয়ে মন্ত্রী নিয়মবিরুদ্ধ কাজ করলেন কি না, উঠেছে সেই প্রশ্নও। মন্ত্রীর দাবি, তিনি মামলা লড়েছেন একজন আইনজীবী হিসেবে, মন্ত্রী হিসেবে নয়। আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের আবার দাবি, তিনি বিষয়টি জানেনই না!
কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায় কিন্তু মনে করেন, “নীতিগত ভাবে এটা করা যায় না। তা ছাড়া, রাজ্যের মন্ত্রীর অভিযুক্তের পক্ষে সওয়াল করাটা সম্পূর্ণ বেআইনি।” কেন? মিলনবাবুর ব্যাখ্যা, “রাজ্য সরকারের বেতনভুক মন্ত্রী কখনই সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেন না। এক জন সাংসদ বা বিধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে সওয়াল করতে পারেন। কিন্তু মন্ত্রী নন।” এর পরে শ্যামাপ্রসাদবাবুর মন্ত্রিত্বে থাকা উচিত নয় বলে মন্তব্য করেছেন মিলনবাবু।
কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, “মন্ত্রীর এই কাজ সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ। এক জন মন্ত্রী অভিযুক্তের পক্ষে দাঁড়িয়ে রাজ্যের বিরুদ্ধে সওয়াল করছেন, এটা কোনও ভাবেই আইনগ্রাহ্য নয়।” মিলনবাবু মতো বিকাশবাবুও মনে করেন, মন্ত্রী যখন সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করেন, তখন তাঁর উচিত আগে নিজের পদটা ত্যাগ করা।
শ্যামাপ্রসাদবাবু অবশ্য পদত্যাগের কথা ভাবছেনই না। এ দিন বিষ্ণুপুর আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে শ্যামবাবু বলে দিয়েছেন, “আমি বিষ্ণুপুর বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য তথা তৃণমূল জেলা আইনজীবী সেলের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছি। দলের এক বিধায়কের জামিনের জন্য এক জন আইনজীবী হিসেবেই আদালতে সওয়াল করেছি। মন্ত্রী হিসেবে নয়।” আইনমন্ত্রীও এ নিয়ে কোনও বিতর্কে জড়াতে চাননি। রাজ্যের মন্ত্রী কোনও মামলায় রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কি সওয়াল করতে পারেন? চন্দ্রিমার জবাব, “আমি জানি না। না জেনে মন্তব্য করব না।” তিনি কি বিষয়টি জেনে তাঁর মতামত জানাবেন? মন্ত্রীর জবাব, “এক জন মন্ত্রীর জন্য অন্য এক মন্ত্রী মন্তব্য করবেন, এটা কোনও কাজের কথা নয়। আর কোথায় কোন আইনজীবী কোন মামলায় দাঁড়াবেন, তা নিয়ে আমার কিছু করার নেই।”
কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা এ ব্যাপারে একটি মামলার কথা শ্যামবাবু ও চন্দ্রিমাকে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন। তাঁরা বলছেন, দু’বছর আগে তৎকালীন অ্যাডভোকেট জেনারেল অনিন্দ্য মিত্র একটি বেসরকারি সংস্থার ক্যাশিয়ারের পক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে সওয়াল করেছিলেন কলকাতা হাইকোর্টে। ওই ক্যাশিয়ারকে জনগণের টাকা তছরুপের অভিযোগে কলকাতা পুলিশ ধরেছিল। অনিন্দ্যবাবু কলকাতা হাইকোর্টে ওই ক্যাশিয়ারের পক্ষে পুলিশের দায়ের করা সমস্ত মামলা খারিজ করার জন্য সওয়াল করেন। বিচারপতি প্রসেনজিৎ মণ্ডল অনিন্দ্যবাবুর সওয়ালের পরে সব মামলা খারিজ করার নির্দেশও দেন।
কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা বলছেন, পরে বিচারপতি অহলুওয়ালিয়ার এজলাসে একটি পাল্টা মামলা দায়ের করেন আইনজীবী কৃষ্ণেন্দু গুপ্ত। সেই মামলার সূত্র ধরে বিচারপতি অহলুওয়ালিয়া জানতে চান, রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল কী করে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মামলা লড়তে পারেন? তিনি এক মাসের মধ্যে অনিন্দ্যবাবুকে এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার নির্দেশও দেন। এর অব্যবহিত পরেই অবশ্য অনিন্দ্যবাবু অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পরে তিনি অ্যাডভোকেট জেনারেলের পদ থেকে পদত্যাগও করেন।
আইনজীবীরা বলছেন, বিচারপতি অহলুওয়ালিয়ার এই নির্দেশ থেকেই পরিষ্কার যে সরকারের অঙ্গ বা প্রতিনিধি কেউ সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করার অথর্, সরকারের বিরুদ্ধেই অনাস্থা প্রকাশ। রাজ্যের মন্ত্রীরাই সেই নির্দেশ না মানলে অন্যেরা তা কী ভাবে মানবেন, সেই প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্টের একাধিক আইনজীবী।
বস্ত্রমন্ত্রীর অবশ্য এ সব নিয়ে কোনও হেলদোলই নেই। তাঁর দাবি, “আমি বেআইনি বা নীতি-বিরুদ্ধ কাজ করিনি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy